অপরাধ ও দুর্নীতি ৪ এপ্রিল, ২০২৪ ০৪:৩৬

ঈদের আগে প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী 

নিজস্ব প্রতিবেদক  

•ঈদ কেন্দ্র করে সক্রিয় মৌসুমি অপরাধীরা
•অজ্ঞানপার্টি, ছিনতাইকারীর পাশাপাশি মাঠে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা
•যে কোনো অপরাধ ঠেকাতে প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী

যে কোনো বড় উৎসব-পার্বণ কেন্দ্র করে দেশে আরও সক্রিয় হয় অপরাধী চক্র। বাড়ে মৌসুমি অপরাধীর সংখ্যা। ঘরে-বাইরে চলার পথে এসময় বাড়ে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য। মুসলমান ধর্মাবলম্বিদের অন্যতম বড় উৎসব ঈদুল ফিতর কেন্দ্র করে রমজানের শুরুতেই সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, টানাপার্টি ও কিশোর গ্যাং চক্রের তৎপরতা বেড়েছে। আর এ চক্রের অপতৎপরতা ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।


আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদুল ফিতর ঘনিয়ে আসতেই ঢাকায় ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানেও থেমে নেই অপরাধ। এ সময়ে মৌসুমি অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। আবার কারাগার থেকে যারা জামিনে বের হচ্ছেন তারাও বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হচ্ছেন।

ডিএমপি বলছে, ঢাকা মহানগরের সব এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অজ্ঞানপার্টি ও মলমপার্টির তৎপরতা ঠেকাতে মাঠে আছেন পুলিশ সদস্যরা। রাজধানীর বড় বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র, শপিংমলে নেওয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এসব এলাকা চিহ্নিত করে ইউনিফর্মে ও সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও।


গত ২৫ মার্চ রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে দেশীয় অস্ত্রসহ ডাকাতদলের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সদস্যরা। এসময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত দুটি চাপাতি ও দুটি ছোরা উদ্ধার করা হয়। র‍্যাব-২ জানায়, গ্রেফতাররা একটি সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের সক্রিয় সদস্য। তারা বেশ কিছুদিন ধরে মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় দেশীয় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চুরি ও ডাকাতি করে আসছিল। রমজান ও ঈদের আগে তাদের ডাকাতির কার্যক্রম বাড়ে।


ঈদ কেন্দ্র করে অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি , টানাপার্টি ও কিশোর গ্যাং চক্রের তৎপরতা রোধে ডিবির একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। ঈদের আগে ও পরে এবং ঈদযাত্রায় মানুষ যাতে নিরাপদে ঢাকা ছাড়তে পারে এজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।- ঢাকা মহানগর (গোয়েন্দা) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ

 

রমজান কেন্দ্র করে ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি ও কিশোর গ্যাং চক্রের তৎপরতা ঠেকাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে র‌্যাব। এরই মধ্যে অভিযানে রাজধানীর বিমানবন্দর, বনানী, মহাখালী, ভাটারা, আব্দুলাহপুর, টঙ্গী ও গাজীপুর এলাকা থেকে ছিনতাইকারী চক্রের ৩২ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে বাহিনীটি।

র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘রমজান কেন্দ্র করে সম্প্রতি ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি ও কিশোর গ্যাং চক্রের তৎপরতা বেড়েছে। ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা নিরীহ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে র‌্যাব-১ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় এবং রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত সংঘবদ্ধ চক্রকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।’


এরই ধারাবাহিকতায় রোববার রাতে র‌্যাব-১ এর আভিযানিক দল রাজধানীর বিমানবন্দর, বনানী, মহাখালী, ভাটারা, আব্দুলাহপুর, টঙ্গী ও গাজীপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছিনতাইকারী চক্রের ৩২ সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করে। এসময় তাদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত ২১টি চাকু, ১৯টি মোবাইল ফোন, একটি মানিব্যাগ, চারটি ছুরি ও নগদ ৯ হাজার ৯৯০ টাকা উদ্ধার করা হয় বলে জানান তিনি।

র‌্যাবের পাশাপাশি অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন। গত ২৪ মার্চ রাজধানীর পুরান ঢাকার কদমতলী থানার জনতাবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি অপহরণ চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সংস্থাটি বলছে, সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একটি চক্র ঈদ টার্গেট করে অপহরণের মিশনে নামে। মাওয়া থেকে ডিবি পরিচয়ে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ নিয়ে নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় ফেলে দেন তারা। এরপর পুরান ঢাকা হয়ে মুন্সিগঞ্জে ফেরার পথে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে চক্রের মূলহোতাসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।

২৪ মার্চ রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকা থেকে চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পাঁচটি কিশোর গ্যাংয়ের ২৫ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-২। র‌্যাব-২ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার শিহাব করিম জানান, রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকায় বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছিল। ২৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসময় তাদের কাছ থেকে অপহরণের কাজে ব্যবহৃত মাইক্রোবাস, চাপাতি, দা, ডিবি পুলিশ লেখা স্টিকার, সাংবাদিকের পরিচয়পত্র, দড়ি, গামছা, মোবাইল সেট, সুইচ গিয়ার, খেলনা পিস্তল ও হ্যান্ডকাপ উদ্ধার করা হয়।

ঈদ কেন্দ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের চাঁদাবাজিও বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরা, বাড্ডা, মহাখালী, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, পল্টন, যাত্রাবাড়ী, ওয়ারীর বিভিন্ন সড়কে চাঁদাবাজি করছে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা।

তবে বাসাবাড়ি, সড়ক ও যানবাহনে তৃতীয় লিঙ্গের কেউ চাঁদাবাজি করলেই তাদের আইনের আওতায় আনার কথা জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান।

তিনি বলেন, সম্প্রতি শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় একটি ঘটনায় তৃতীয় লিঙ্গের একজনের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের বিভিন্ন সদস্যের নামে বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব অভিযোগের আলোকে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

ছিনতাই রোধে ডিএমপির আট বিভাগে টাস্কফোর্সের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে ডিসি ও থানা পুলিশ একসঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। টাস্কফোর্স গঠনের পর বর্তমানে ডিএমপিতে ছিনতাইয়ের হার নিম্নমুখী। অর্থাৎ কমতে শুরু করেছে। ঢাকার বিপণিবিতান, বিভিন্ন মার্কেট, বাস, রেল ও লঞ্চ স্টেশনগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সব ধরনের অপতৎপরতা বন্ধে ডিএমপি সর্বদা তৎপর।- ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান

 
র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঈদের কয়েকদিন আগ থেকেই প্রতিটি সড়ক, রেল ও নৌ-পথে প্রচুর যাত্রীর সমাগম হয়। তাছাড়া ঈদের নামাজেও অসংখ্য মুসল্লির জমায়েত হয়। অধিকাংশ লোকজন এসময় ছুটিতে থাকায় ফাঁকা থাকে ঢাকা শহর। ফলে ছিনতাই, চুরি ও ডাকাতির মাত্রা বৃদ্ধিসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আশঙ্কা থাকে। ঈদুল ফিতর কেন্দ্র করে প্রতি বছরের মতো এবারও র‌্যাব বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ঈদে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র‌্যাব ফোর্সের ব্যাটালিয়নগুলো নিজ নিজ এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াবে। পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হবে। সারাদেশে র‌্যাবের কন্ট্রোল রুম, স্ট্রাইকিং রিজার্ভ, চেকপোস্ট ও সিসিটিভি মনিটরিংসহ যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় র‌্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ডগ স্কোয়াড ও হেলিকপ্টারগুলো সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হবে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ শপিংমল, বিপণিবিতানসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে ও নিরাপদে ঈদ উদযাপন করতে পারেন।’


জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর (গোয়েন্দা) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঈদ কেন্দ্র করে রাজধানীর বড় বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র, শপিংমলে নেওয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এসব এলাকা চিহ্নিত করে গোয়েন্দা সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। থানা পুলিশের টহল টিমসহ বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। ছিনতাই ঠেকাতে মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় অনেক অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান। ঈদ ঘিরে যেন কোনো বিশৃঙ্খলা না হয় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘ঈদ কেন্দ্র করে অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি , টানাপার্টি ও কিশোর গ্যাং চক্রের তৎপরতা রোধে ডিবির একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। ঈদের আগে ও পরে এবং ঈদযাত্রায় মানুষ যাতে নিরাপদে ঢাকা ছাড়তে পারে এজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছিনতাই রোধে ডিএমপির আট বিভাগে টাস্কফোর্সের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে ডিসি ও থানা পুলিশ একসঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। টাস্কফোর্স গঠনের পর বর্তমানে ডিএমপিতে ছিনতাইয়ের হার নিম্নমুখী। অর্থাৎ কমতে শুরু করেছে। ঢাকার বিপণিবিতান, বিভিন্ন মার্কেট, বাস, রেল ও লঞ্চ স্টেশনগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সব ধরনের অপতৎপরতা বন্ধে ডিএমপি সর্বদা তৎপর।’

তিনি বলেন, ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে প্রায় দেড় কোটি মানুষ বাইরে যাবেন। এ সময়ে ঢাকা শহর ফাঁকা থাকে। তাই আমরা পরামর্শ দেবো মূল্যবান জিনিসপত্রের বিষয়ে নিজেরা সজাগ থাকবেন এবং সচেতন থাকবেন। পুলিশের পক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টা বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ছুটি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলমান থাকবে।