ডেস্ক রিপোর্ট ।।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা-উত্তর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণ আমি ফেসবুকে শুনছিলাম। জাতীয় শোক দিবস ঘনিয়ে এলে ইউটিউবে এসব ভাষণ বেশ শোনা যায়। এছাড়া পাড়া-মহল্লায়ও শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা থাকে।
অবশ্য অধিকাংশ মহল্লায়ই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি বাজাতে শোনা যায়। সন্দেহ নেই, ৭ মার্চের ভাষণটি একটি যুগান্তকারী ভাষণ। ৭ মার্চের ভাষণ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর এমন অনেক দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ আছে, যা সচরাচর বাজাতে শুনি না।
এবার সম্ভবত জাতীয় দিবসকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর এমনই একটি ভাষণ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু রেজাউলের ফেসবুকের ওয়ালে দেখে আমি বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণটি আগ্রহ নিয়ে শুনলাম। ভাইরাল হওয়া এ ভাষণটি আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। আমার বন্ধু বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের মধ্যম সারির একজন নিবেদিত নেতা। তিনি অবশ্য নিজেকে নেতা ভাবেন না, বরং নিজেকে সবসময় তার দলের একজন কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
আমিও বরাবরই তাকে একজন একনিষ্ঠ কর্মীর মতোই দলের জন্য কাজ করতে দেখেছি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, তার অর্থ উপার্জনের পথটি বেশ সরল এবং উপার্জনের চাকাটি আট-দশ বছর আগের মতোই এখনও একই গতিতে চলমান।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বক্তব্য সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে কী রকম ভিশনারি নেতা ছিলেন অর্থাৎ দূরদর্শী বক্তা ছিলেন তার এ ভাষণটি শুনলে তা বোঝা যায়।’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, বঙ্গবন্ধু তো এরকম আরও অনেক ভাষণ দিয়েছেন, এ ভাষণটিই কেন তার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে? উত্তরে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণটি খুবই প্রাসঙ্গিক ও জরুরি বলে তার মনে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর অনেক বক্তৃতা আমরা শুনেছি। স্বাধীনতা-উত্তর বিভিন্ন বক্তৃতা, বিবৃতিতে কিংবা দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু সব সময় বাংলাদেশকে নিয়ে তার চিন্তা-চেতনা এবং ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা বলতেন। তিনি তার বক্তব্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, আমলা, কৃষক-শ্রমিক এবং অন্যান্য আরও প্রসঙ্গ নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে গেছেন। তার সেদিনের সেসব কথা, সতর্কবার্তা এবং নির্দেশনা বাংলাদেশের জন্য আজও সমভাবে প্রযোজ্য।
সেদিক দিয়ে বিবেচনা করে সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি একটি অন্যতম মাইলফলক বলে আমার মনে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই ভাষণের বক্তব্যগুলো ছিল এরকম : ‘এত চোরের চোর। চোর কোথা থেকে যে পয়দা হয়েছে আমি জানি না।
পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে; কিন্তু এ চোরগুলো রেখে গেছে আমার কাছে। এ চোরগুলো নিয়ে গেলে আমি বাঁচতাম। শতকরা বিশজন লোক শিক্ষিত। তার মধ্যে শতকরা পাঁচজন আমরা বলতে পারি উচ্চশিক্ষিত।
আজকে একটা প্রশ্ন আমার, এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? নাহ্। আমার শ্রমিক? নাহ্। তাহলে কে? ঘুষ খায় কারা? স্মাগলিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান করে কারা? এই আমরা যারা শতকরা পাঁচজন শিক্ষিত লোক, এই আমাদের মধ্যে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ এবং এই আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে, আত্মসমালোচনা করতে হবে। এসব দুর্নীতিবাজ এই শতকরা পাঁচজনের মধ্যেই, এর বাইরে নেই।
কেন নেই? কারণ আমার কৃষক দিনভর পরিশ্রম করে। শিক্ষিত সমাজকে আজ একটি কথা বলব, আমাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি।’
বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যটি দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কতখানি যে প্রাসঙ্গিক, পাঠকমাত্রই তা উপলব্ধি করতে পারছেন। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, আমার বন্ধুর সেই পোস্টে যতগুলো লাইক চিহ্ন পড়েছে তার শতকরা নব্বইজনই হল একই দলের কর্মী ও সমর্থক। এর মধ্যে অনেকেই পোস্টটি শেয়ারও করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মনোযোগ দিয়ে শোনার পর আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে, ‘আমাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি,’ এ অংশটুকু। আমার বিশ্বাস পাঠকের কাছে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের এ অংশটুকুর বিশদ ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন নেই। দেশের বর্তমান সচেতন নাগরিক সমাজ বঙ্গবন্ধুর এ দুঃখবোধ, কষ্ট এবং ক্ষোভ খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারবেন। নিজেদের কর্মকাণ্ডের আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির জন্য বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণটি পোস্ট করেছেন বলে আমার বন্ধু জানিয়েছেন।
‘নিজেদের কর্মকাণ্ড’ বলতে তিনি শুধু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মানুষের কথা বোঝাননি, বর্তমান দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, অর্থ লুটপাটকারী, বিদেশে অর্থ পাচারকারী সিন্ডিকেট এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে ঘাপটি মেড়ে বসে থাকা বিদেশি এজেন্টদেরও বুঝিয়েছেন। এটি তার একান্ত নিজস্ব উপলব্ধি মাত্র।
বাংলাদেশে ‘দুর্নীতি’ এমন একটি বিষয় যা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে, প্রচুর গবেষণা-আত্মসমালোচনাও হয়েছে। দুর্নীতির পথ থেকে বেরিয়ে আসার অনেক সমাধানের কথাও বলা হয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে এ ব্যাপারে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বরং দিন দিন আমরা যেন দুর্নীতির ঘেরাটোপে আটকে যাচ্ছি। আমাদের দেশে একশ্রেণীর অদ্ভুত মানুষ আছেন যারা বছরের পর বছর দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
প্রতি বছর এসব অদ্ভুত মানুষই ধনী থেকে আরও বেশি ধনী হচ্ছেন। এসব ব্যক্তিকে আমি অদ্ভুত মানুষ বলছি এই কারণে যে, তাদের অর্থ উপার্জনের উৎস দিবালোকের মতোই পরিষ্কার। অথচ তাদের দুর্নীতির কর্মকাণ্ড, যেমন- ব্যাংক লুট, শেয়ার মার্কেট লুট কিংবা প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনা জনসম্মুখে প্রকাশ পেলেও এসব দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের বিরুদ্ধে দেশের কোনো আইনেই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। ওরা অস্পৃশ্য। ঘুরেফিরে এ পরিচিত মহলটি সবসময়ই ক্ষমতার বলয়ের আশপাশেই অবস্থান করে থাকে।
প্রকৃত ধনী এবং দুর্নীতির আশ্রয়ে জন্ম নেয়া এসব নব্য ধনীর সংখ্যা হাতে গুনে শতকরা পাঁচজনও নয়। অথচ এ শতকরা পাঁচজন দেশের মোট সম্পদের প্রায় ২৮ শতাংশ অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ সম্পদের মালিক। আমাদের দেশে দিন দিন এই শ্রেণীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। একটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি ছিলেন মাত্র ৫ জন। এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতকালে অর্থাৎ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৪৩ জন।
১৯৯১-২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে কোটিপতির এ সংখ্যা গিয়ে পৌঁছে ৫ হাজার ১৬২ জনে। ২০০১-২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোটিপতি হন ১৪ হাজার একজন। তবে বিগত একদশকে কোটিপতি বৃদ্ধির হার অতীতের সব রেকর্ডকে ভেঙে প্রায় আট গুণ বেড়েছে। এ সময়ে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজারেরও বেশি কোটিপতি হয়েছেন। অর্থাৎ দেশ স্বাধীনের পর ২০০১ সাল পর্যন্ত মোট কোটিপতির যে সংখ্যা ছিল, গত একদশকে প্রতি বছরই তার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি হারে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। অনেকে একথা বলার চেষ্টা করেন, মানুষ অর্থ-সম্পদের মালিক হচ্ছে মানে দেশ সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সবই সত্য! কিন্তু এ সম্পদ বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ যে হারে সম্পদ ভোগ করার কথা ছিল, সে হারে মানুষ কি সেই সম্পদ ভোগ করতে পারছে? দেশের উন্নয়নের ফসল কেবল একশ্রেণির মানুষের গোলাঘরই ভরপুর করছে।
এ হারে কোটিপতি সংখ্যা বৃদ্ধির অর্থ হল দেশের সম্পদ ক্রমেই কিছুসংখ্যক ব্যক্তির হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। ফলে ধনী ও সাধারণ সম্পদশালী মানুষের মধ্যে বৈষম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭২ সালে ২৫ মার্চ স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে মানুষে মানুষে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদ বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে।’ আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রেও স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল।
অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই ছিল বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। অথচ বিশ্ব পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অতিধনী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে প্রথম। অথচ সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের দেশ হিসেবে পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশের মালিক হলেও সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষ মোট সম্পদের মাত্র ০.২৩ শতাংশের মালিক।
জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের আয় হয় কমেছে কিংবা এক জায়গাতেই থমকে আছে। এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ইতিপূর্বে তিনি ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশলগুলো অন্যায্যতা ও তীব্র বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে, যা বাংলাদেশে দুটি সমাজ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সমসাময়িক এ চরিত্রের সঙ্গে স্বাধীনতাপূর্ব তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অর্থনীতির মিল খুঁজে পাওয়া যায়।’
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে যে চোরদের কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেসব চোরের সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণে। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, বিদেশে অর্থ পাচারকারী এবং বিদেশিদের স্বার্থরক্ষাকারী এজেন্টদের সংখ্যাও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ঘুষখোর আর দুর্নীতির বিষবাষ্প এখন শুধু উঁচু মহলেই সীমাবদ্ধ নেই। এর বিস্তার ঘটেছে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে।
আমাদের দেশে এখন খুব কম সংখ্যক সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে যেখানে বিষফোঁড়ার মতো ঘুষ বাণিজ্যের প্রাদুর্ভাব ঘটেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের এমন অনেক সদস্য পাওয়া যাবে যারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। দু-একটি ঘটনা উল্লেখ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। বাংলাদেশ পুলিশের সদ্য সাবেক ডিআইজি মিজানুর রহমানের আয়বহির্ভূত অর্থ উপার্জনের তদন্ত করতে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির নিজেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেছেন।
মিজানুর রহমানকে দায়মুক্তি দিতে একটি গ্যাসচালিত কার ও নগদ ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার জন্য ‘চুক্তি’ করেন তিনি এবং অগ্রিম বাবদ ২৫ লাখ টাকা ঘুষও গ্রহণ করেন বলে খবর বেরিয়েছে। এ কৃতকর্মের ফলে বর্তমানে উভয়েই জেলহাজতে আটক আছেন। ৮০ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার সিলেট কারা কর্তৃপক্ষের ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিকের কাহিনী নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আরও দুটো ঘটনার উল্লেখ করতে চাই এখানে। ঘটনা দুটো কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও এর তাৎপর্য অনেক।
গাইবান্ধা জেলার ৮২টি ইউনিয়নে অতিদরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির কাজের জন্য ২৮ হাজার ৮৪৫ শ্রমিক নিয়োগের মজুরি বাবদ ২৪ কোটি ৪৯ লাখ ২১ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। জানা গেছে, কাগজে-কলমে মাটির কাজ সম্পন্ন দেখানো হলেও রাস্তার কাজের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
দৈনিক ২০০ টাকা মজুরি বাবদ ৪০ দিনে একজন শ্রমিক ৮ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রতিটি শ্রমিক থেকে ৪ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে বাকি ৪ হাজার টাকা শ্রমিকদের ধরিয়ে দিয়ে কাজ না করিয়েই প্রকল্প সম্পূর্ণ হয়েছে বলে দেখানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। অপর ঘটনাটি ঘটেছে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায়। ঘটনাটি খুবই পীড়াদায়ক ও দুঃখজনক।
একটি বেসরকারি সাহায্য সংগঠন হাতিভাঙ্গা ইউনিয়নের ৬৪৮টি বন্যার্ত পরিবারকে ৪ হাজার করে এবং ৭২ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ সাহায্য প্রদান করতে চাইলে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা সাহায্যের অর্ধেক টাকা ঘুষের বিনিময়ে রিলিফের তালিকায় মানুষের নাম অন্তর্ভুক্ত করে।
যেসব পরিবার অর্ধেক টাকা দিতে রাজি হয়েছে, তাদের নাম তালিকায় উঠেছে আর যারা রাজি হয়নি, অতি অসচ্ছল হওয়ার পরও তারা কোনো আর্থিক সাহায্য পায়নি। চাল-চুলাহীন বানভাসি মানুষের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের এই নিষ্ঠুর আচরণ মানবতার চূড়ান্ত স্খলন বললে অত্যুক্তি হবে না।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছেন, ‘চোর কোথা থেকে যে পয়দা হয়েছে আমি জানি না। পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে; কিন্তু এ চোরগুলো রেখে গেছে আমার কাছে। এই চোরগুলো নিয়ে গেলে আমি বাঁচতাম।’ চোর কোথা থেকে পয়দা হয়েছে, তখন বঙ্গবন্ধু জানতে না পারলেও বর্তমানে আমাদের দুর্ভাগ্য, চোর কীভাবে যে তৈরি হচ্ছে তা বুঝতে পারলেও আমরা বলতে পারি না। পাকিস্তানিরা সবকিছু নিয়ে গেলেও চোরদের রেখে গেছে, ওই চোরদের নিয়ে গেলে বেঁচে যেতেন বলে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করেছিলেন।
এখন কথা হল, সেই চোরদের বর্তমান প্রজন্ম তো আমাদের চোখের সামনে এ মাটিতেই গড়ে উঠেছে। ওদের অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর মতো আমাদেরও বলতে ইচ্ছে হয়, ‘ওরা কোথাও চলে গেলে আমরাও বেঁচে যেতাম।’ কিন্তু উপায় নেই। বঙ্গবন্ধু শোষণমুক্ত-দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
কিন্তু আজ যখন দেখি তারই সোনার বাংলায় দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে, দেশের মানুষের জামানতের টাকা মেরে দিয়ে ঋণখেলাপি হওয়ার পরও যখন দেখি তাদেরই আবার বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে, তখন কষ্ট হয়। যখন শুনি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কালো টাকা’কে কালো টাকা বলা ঠিক না, কালো টাকা কথাটা শুনতে ভালো লাগে না (প্রথম আলো- ২৭ জুন ২০১৯), তখন দুঃখবোধ হয় বৈকি।
সরকারি সফর তালিকায় যখন ব্যাংক ও শেয়ার মার্কেট লুটেরাদের নাম দেখা যায়, তখন অনেকের মনেই অনেক প্রশ্ন আসে। হয়তো মনে মনে তারা ভাবেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তিনি আজ কী ভাবতেন।’ আমার বন্ধু রেজাউল খেদ প্রকাশ করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আমরা প্রতি বছর তার শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস পালন করি। প্রতি বছরই আমরা তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের শপথ গ্রহণ করি। দেশ গড়ায় অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। সে প্রতিবন্ধকতা হয়তো দূর করাও সম্ভব। তবে, এসব কুপ্রবৃত্তির মানুষকে দমন না করলে ভবিষ্যতে আর যাই হোক জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া সম্ভব নয়।
একেএম শামসুদ্দিনঃ অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। সূত্রঃ যুগান্তর