ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
ঠাকুরগাঁওয়ের মাঠ থেকে প্রতিদিন ২৫টিরও বেশি ট্রাকে করে সবজি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, চিটাগাংসহ দেশের বড় পাইকারি বাজারগুলো ভরে উঠছে এখানকার ফসল দিয়ে। তবুও উৎপাদিত সবজির কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে হতাশ জেলার চাষিরা।
বর্তমানে সবজির বাজার দর খুবই কম বলে জানিয়েছেন তারা। বিক্রেতা কম থাকায় বেশিরভাগ সবজিই নষ্ট হচ্ছে ক্ষেতে। অনেকে রাগে-ক্ষোভে ক্ষেতেই সবজি নষ্ট করে ফেলছেন।
চাষিরা জানান, বছরের পর বছর ধরে তারা সবজি চাষ করে আসছেন। কিন্তু এবার দাম কমে যাওয়ায় চাষাবাদ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন সবাই। অনেকেই ভাবছেন পরের মৌসুমে সবজি না চাষ করে ধান বা অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকবেন।
ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, জেলায় এ বছর ৪ হাজার ২৫৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির আবাদ হয়েছে। যার মধ্যে ৩ হাজার ৩৪২ হেক্টর কর্তন করা হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৬ লাখ ৬১ হাজার ৪৬০ মেট্রিক টন।
সবজি চাষ এখন ঠাকুরগাঁওয়ের অন্যতম আয়ের উৎস। জেলার সদর, রানীশংকৈল, পীরগঞ্জ, হরিপুর ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় অন্তত প্রায় ২০ হাজারের বেশি পরিবার সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত। এই ফসল রাজধানীসহ দেশের বড় বড় পাইকারি বাজারে সরবরাহ হয়। বাজারে লাউ ১৫-২০ টাকা পিস, করলা ২০ টাকা কেজি, চিচিঙ্গা ১৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের খড়িবাড়ি এলাকার কৃষক আবু বক্কর ভোরে লাউ বোঝাই করে বাজারে এনেছেন। কিন্তু ক্রেতার অভাব আর দামের পতনে মন খারাপ তার। ক্ষোভ নিয়ে পোস্টকে বলেন, যে লাউ আমি মাঠে বিক্রি করি ৪টা ১৫ টাকায়, সেই লাউই শহরের বাজারে ১৫ টাকা পিস বিক্রি হয়। করলা বিক্রি করি ৬ টাকা আর চিচিঙ্গা ২ টাকা কেজিতে। এই দামে বিক্রি করলে কীভাবে টিকে থাকব? গত বছর যে লাউ ২০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, এবার তার দাম নামছে একেবারে ৪ টাকায়।
একই হতাশা শোনা গেল সদর উপজেলার পাটিয়াডাঙ্গী এলাকার কৃষক জাকারিয়ার কণ্ঠেও। তিনি বলেন, দুই বিঘা জমিতে করলা চাষ করেছি। সার, কীটনাশক, শ্রমিক, পানি সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ৬০ হাজার টাকার মতো। এখন বিক্রি করে পেলে ৩৫ হাজার টাকাও হবে না। খরচ তো উঠছেই না, উল্টো ধার-দেনা বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, পাইকাররা আমাদের কাছ থেকে কাচামাল নিয়ে যাচ্ছে ঢাকায়। বিক্রি হলে হাতে টাকা পাই না হলে কপালে হাত। তারা আমাদের কাছ থেকে বাকিতে করে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। বলা যায় আমাদের কাছ থেকে সবজি নিয়ে যাওয়ার ৫ দিন টাকা পাই।
লাউচাষি পারভেজের কথায় মিশে আছে কষ্টের সুর। তিনি বলেন, আমি ধার করে জমি চাষ করেছি। এখন সব বিক্রি করেও ঋণ শোধ করা যাবে না। যদি এমন চলতে থাকে, আমাদের মতো ক্ষুদ্র কৃষকেরা একদিন একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন এখান থেকে অন্তত ২৫ ট্রাক সবজি দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। কিন্তু পাইকারি দরে দাম একেবারে পড়ে গেছে। কৃষক কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে, আবার শহরে গিয়ে সেই সবজি বিক্রি হয় দ্বিগুণ দামে। মধ্যস্বত্বভোগীরাই লাভবান হচ্ছে।
আরেক কৃষক রাজিবুল ইসলাম বলেন, এক বিঘা জমিতে করলা চাষে আমার খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এখন পুরো মাঠের করলা বিক্রি করেও হয়তো ১৫ হাজার টাকাও উঠবে না। কৃষি যদি এমন ক্ষতির খাত হয়, তাহলে পরের মৌসুমে অনেকেই আর চাষ করবে না।
সবজি আড়ৎদার সোহরাব হোসেন বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। গাড়ির ভাড়ার টাকা তোলা দায় হয়ে পড়েছে। একটা গাড়ি ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকায় যেতে ভাড়া নেয় ২৫-৩০ হাজার টাকা। আবার রাস্তাঘাটে পুলিশ ও চাঁদাবাজদের হয়রানি লেগেই আছে। কাগজ দেখার নামে নানা ধরনের হয়রানি হয়। কোনোদিন এক গাড়িতে লাভ হয় ১৫-২০ হাজার টাকা। আর লস হলে সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা।
আরেক ক্রেতা বলেন, এখান থেকে কাচামাল ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। কিন্তু লাভের মুখ তো দেখেনি। বরং শ্রমিক মজুরি, গাড়ি ভাড়াসহ সব মিলে দিন শেষে দেখা যায় আরও ঘাটতি। তারপর আবার অনেক সময় কাচামাল নষ্ট হয়ে যায়, সেখানেও লস। ৪ দিন ধরে টানা বৃষ্টি কাঁচামাল ক্ষেত্র থেকে তুলে আনা হয়েছে কিন্তু গাড়িতে লোড করা যাচ্ছে না। এতে অনেক সবজি নষ্ট হয়ে গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাজেদুল ইসলাম বলেন, ঠাকুরগাঁও থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০-২৫ সবজির ট্রাক ঢাকার উদ্দেশ্যে যায়। সেগুলো কিন্তু সব গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজি। আমাদের সবজি ঠাকুরগাঁও জেলাসহ দেশের চাহিদা পূরণ করে। এই যে ৪৬ হাজার টন সবজি উৎপাদন করেছে আমাদের কৃষকেরা সেগুলো জেলার বাইরে চলে গেছে। আগে কৃষকেরা ভালো দাম পেলেও এখন কিছুটা কম। কিন্তু লাভের মধ্যেই আছে।
তিনি আরও বলেন, আগাম সবজি হিসেবে এ জেলায় প্রায় ৩ হাজার ৩৮ হেক্টর জমি আছে। কৃষকের সব চেয়ে বড় অর্থকারী ফসল হলো সবজি। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষকেরা। এখন পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ বের করতে পারিনি। এক সপ্তাহ না গেলে বলা যাবে না কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। আশা করি কৃষকরা তাদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে।





















