জবি প্রতিনিধি: শিক্ষার্থীদের আবেগ-অনুভূতির এক পরম প্রতিষ্ঠান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের মাঝেই যেন পূর্ণতা খুঁজে পাই ছাত্র-ছাত্রীরা। গভীর আগ্রহ নিয়ে কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যায়ে ভর্তি হয়ে মনের মধ্যে কল্পনার এক জগত খুলে বসে তারা। কিন্তু বাস্তবে এসে যখন পরিবেশটা ভিন্ন দেখে তখন মনের মধ্যে অপূর্ণতার তৃপ্তি দেখা দেয়। শিক্ষার্থীদের তেমনই এক অপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত হল থাকাটা অবশ্যক। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ১৭ বছরে শিক্ষার্থীদের মাত্র একটি আবাসিক হলের চাহিদা পূরণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো হলগুলো উদ্ধার, উদ্ধার হওয়া হলগুলোর সংস্কার এবং নতুন হল নির্মাণের দাবি এখনও অপূর্ণই রয়ে গেছে।
২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হলেও বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানটির নানাবিধ সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে দেখা গেছে। তবে আন্দোলন করেও সমস্যার হয়নি কোন সমাধান।
বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) সকালে ক্যাম্পাসে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতার উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ইমদাদুল হক।
২০০৫ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের পর ২০১৪ সালে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হল নির্মাণের কাজ শুরু হয় লিয়াকত এভিনিউয়ে। এটিই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম হল। সেই হলে ছাত্রীরা ওঠেন চলতি বছরের মার্চে।
এই হলের আবাসিক ছাত্রী তূর্ণা মজুমদার বলেন, হলের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসটি আরও ভালোভাবে উপভোগ করতে পারব। অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ সন্ধ্যা। বাড়িটা অনেক দূরে, আমাকে আরেকবার চলে যেতে হয়েছিল, এবার হল থেকে দেখতে পাচ্ছি।"
তিনি বলেন, “হলে থাকায় আমরা কিছুটা হলেও ভালো আছি। কিন্তু আমাদের বন্ধুরা যারা হলে থাকার সুযোগ পাইনি, তারা মেসে অনেক কষ্টে থাকে, কর্তৃপক্ষের উচিত সেদিকে নজর দেওয়া।"
ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থী বৃষ্টি আক্তার বলেন, “ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো হল নির্মাণ করা উচিত। একটা হলে তো খুব বেশি শিক্ষার্থী থাকার সুযোগ নেই। আর আমাদের বিশ্ববদ্যালয়ে একটা কিছু শুরু করা মানে কয়েক যুগ কেটে যায়৷ তাই দাবি জানিয়েও আসলে কোনো লাভ নেই৷"
বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ হাজারের বেশি। এছাড়া ছয়টি অনুষদের আওতায় ৩৬টি বিভাগ এবং দুটি ইনস্টিটিউট আছে।
নতুন ক্যাম্পাস কতদূর?
একনেক শিক্ষার্থীদের বাসস্থানসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন করে। প্রায় ২০০ একর জমিতে ১,৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা মূল্যের এই প্রকল্পটি ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। তবে নতুন ক্যাম্পাসের ২০০ একর জমির মধ্যে ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি বুঝিয়ে দেয় ঢাকার জেলা প্রশাসন। হস্তান্তর বাকি রয়েছে ১১ দশমিক ৪০ একর জমি। শেষ হয়নি সীমানপ্রাচীরের কাজও। কয়েক ধাপ বাড়িয়ে সেই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত গড়িয়েছে।
অনুমোদনকৃত হল হবে কী?
১৯৮৫ সালের পর পুরান ঢাকার বিভিন্ন পরিত্যক্ত বাড়িতে জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ছাত্রদের নির্মিত হোস্টেলগুলো ধীরে ধীরে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষার্থীদের কয়েক দফা আন্দোলনের মুখে সরকার হল উদ্ধারে একাধিক কমিটি গঠন করলেও খালি হওয়া ১১টি হলের মধ্যে দুটি ছাড়া বাকিগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ও কর্মচারী এসব পুরনো ভবনে থাকলেও কোনোটিই বসবাসের উপযোগী নয়।
হল উদ্ধারে নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক ছাত্রনেতারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের তীব্র আবাসন সংকট থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এসব স্থাপনার উন্নয়ন হয়নি। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, সরকারের বরাদ্দ ও নির্দেশনা ছাড়া হলগুলোর পরিকল্পনায় যেতে পারছেন না তারা।
খেলার মাঠ
শতবর্ষী জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়ার পর বিলুপ্ত কলেজের অধিকাংশ সম্পত্তি আইন অনুযায়ী অডিট করে বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হয়। ক্যাম্পাসের সীমানার বাইরে শুধু দুপখোলা খেলার মাঠ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্বে। কিন্তু গত বছর সেটিও হারায় বিশ্ববিদ্যালয়টি।
এই মাঠেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করে আসছিল কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনের আয়োজন হয়েছিল সেখানে, তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এখন সাড়ে সাত একর আয়তনের মাঠটিকে নিজেদের সম্পত্তি দাবি করে সেখানে মার্কেট তৈরির কাজ করছে।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা
প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রথম বর্ষের সিফাত আহমেদ বলেন, "বেশ কয়েক বছর আগে আমার এক ভাই পড়ছেন এখানে; তার সময় থেকে শুনতেছি সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় হবে। এখনো কিছুই হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্তরিক হলে এত সময় লাগার কথা না। কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের অনুরোধ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষার্থীর সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতে তারা যেন দ্রুত পদক্ষেপ নেন।"
ইংরেজি বিভাগের স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত হোসাইন বলেন, "ক্যাম্পাসে এসে তো কতকিছু হবে শুনছি। কিছুই কিন্তু হচ্ছে না। আমাদের পড়াশোনার চেয়েও মূল চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থ উপার্জন। বিশ্ববিদ্যালয়টা আবাসিক হলে কিন্তু আমাদের পয়সার পিছনে ছুটতে হত না। পড়াশোনায় তখন পূর্ণাঙ্গ মনোযোগ দেওয়া যেত। অন্তত কয়েকটা হল দ্রুত বানানো উচিত।"
মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নূর হোসেন টিপু বলেন, "আমাদের তো বিশ্ববিদ্যালয় লাইফ শেষ, আমরা যেটা পাইনি সেটা আমাদের জুনিয়ররা পাক সেই প্রত্যাশা করি। কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি থাকবে, উনারা যেন আমাদের পুরনো হলগুলো উদ্ধার করেন।
ব্রাহ্ম স্কুল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
১৮৫৮ সালে আরমানিটোলায় ব্রাহ্মসমাজের নিজস্ব প্রাঙ্গণে সাধারণ ছাত্রদের ব্রাহ্ম ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষিত করার জন্য একটি অবৈতনিক ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল চালু করা হয়েছিল। ১৮৭২ সালে আর্থিক সংকটের কারণে, ব্রাহ্ম স্কুলের দায়িত্ব বালিয়ার জমিদার কিশোরলাল রায় চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করা হয়, পরে জমিদারের পিতার নামানুসারে এটি 'জগন্নাথ স্কুল' নামকরণ করে। এরপর উপমহাদেশের দেড় শতাব্দী প্রাচীন বিদ্যাপীঠটি চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে বর্তমান ঠিকানায় চলে যায়।
১৮৮৪ সালে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। ১৮৮৭ সালে 'কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল' নামে স্কুল শাখাটি জগন্নাথ কলেজ থেকে আলাদা করা হয়, যা এখন কেএল জুবিলি স্কুল নামে পরিচিত। ১৯২০ সালে ভারতীয় আইন পরিষদ জগন্নাথ কলেজ আইন পাস করে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর জগন্নাথ কলেজের স্নাতক প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে যায় এবং শিক্ষা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
১৯৪২ সালে মেয়েদেরও জগন্নাথ কলেজে ভর্তির সুযোগ হয়। পরে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ দিতে জগন্নাথ কলেজে নৈশকালীন পাঠদান শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে জগন্নাথকে সরকারি (প্রাদেশিকীকরণ) করা হয়, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফায় এর বিরোধিতা করলে ওই বছরই কলেজটি আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জগন্নাথ কলেজকে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর স্তরে উন্নীত করা হয়। ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয় এবং এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টিকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়।
সবকিছু পেরিয়ে এখন শিক্ষার্থীদের একটায় প্রত্যাশা, তারা যেন হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসকল সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান পাই। তবে কতটুকু সমাধান হবে দেখার অপেক্ষায় হাজারো শিক্ষার্থী।