অপরাধ ও দুর্নীতি ২২ আগস্ট, ২০১৯ ০৭:০০

কর্ণফুলী নদীর উচ্ছেদ অভিযানে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ

ডেস্ক রিপোর্ট।। 

বর্তমান সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার কাজের মধ্যে একটি হলো অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া নদীগুলোর জায়গা উদ্ধার করা। এর মধ্যে ঢাকার বুড়িগঙ্গা,তুরাগসহ চারটি এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী অন্যতম। ঢাকার নদী গুলোর জায়গা উদ্ধার করা হলেও কর্ণফুলীর দখল করা জায়গা উদ্ধার কাজ শুরু করে তা মাঝ পথেই বন্ধ করা হয়েছে।

দুই হাজার ৩৭০ কোটি টাকা মূল্যের ১৫৮ একর ভূমি উদ্ধারে একসঙ্গে কাজ করতে তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালতও। কিন্তু মাত্র ১০ একর ভূমি উদ্ধার করেই উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করে দেয়া হয়। কর্ণফুলী নদী রক্ষায় সমন্বিতভাবে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছিল চার সরকারি সংস্থা- চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিআইডব্লিউটিএ। সমকাল’র এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে আসে।

যখন নদীতীর দখল করে সরকারি এ সংস্থাগুলোর গড়ে তোলা বিভিন্ন স্থাপনা যখন উচ্ছেদের আওতায় এসেছে, তখনই 'কর্ণফুলীর মাস্টারপ্ল্যান' করার অজুহাতে অভিযান বন্ধ করে দিয়েছে তারা। দখলদার রাঘববোয়ালদের বাঁচাতে এখন এক সংস্থা দায় চাপাচ্ছে আরেক সংস্থার ওপর। অথচ চট্টগ্রামের প্রাণপ্রবাহ নামে পরিচিত কর্ণফুলী দখল ও দূষণে বিপর্যস্ত হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই এখন নগর ভাসে কোমরপানিতে।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, 'অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে কর্ণফুলীতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হলেও সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে নীরবে। সাধারণ মানুষের স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে কিছু জায়গা উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু যখন রাঘববোয়ালদের স্থাপনা সামনে আসে তখন মাস্টারপ্ল্যান করার অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ করা হলো অভিযান।’

তিনি আরো বলেন, ‘যারা এ অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন তাদের বিরুদ্ধেই নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণ কিংবা লিজ দেয়ার অভিযোগ ছিল। সরকারি সংস্থাগুলোর কূটকৌশলের কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নগরীর ৬০ লাখ মানুষ। সামান্য বৃষ্টিতে নগর ডুবে যায় কোমরপানিতে।'

কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান শুরুর আগে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেছিলেন, 'স্বাধীনতার পর এই প্রথম সমন্বিতভাবে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা হবে কর্ণফুলীতে। এ নদী চট্টগ্রাম শহরের প্রাণ। তাই যে কোনো মূল্যে একে দখলমুক্ত করা হবে এবার। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের একটিও অক্ষত থাকা অবস্থায় অভিযান চলবে। দখলদাররা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন তাদের এবার শেষ রক্ষা হবে না।'

এর আগে ২০১০ সালের জুলাই মাসে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এ নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে কর্ণফুলী নদী দখল, মাটি ভরাট ও নদীতে যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।

আদালতের নির্দেশনা মতে জরিপ করে নদীর দুই তীরে দুই হাজার ১৮১ অবৈধ স্থাপনা আছে বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন। জরিপ প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালের ৯ জুন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার ও অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে হাইকোর্টে দাখিল করে জেলা প্রশাসন। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি কাশেফা হোসেনের ডিভিশন বেঞ্চ সব স্থাপনা উচ্ছেদে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দেন। কিন্তু তিন মাসের স্থলে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছিল তিন বছর পর।

জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ উচ্ছেদ অভিযানে সংযুক্ত করা হয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিআইডব্লিউটিএকে। এসব সংস্থার সহায়তায় প্রথম ধাপে ১০ একর ভূমিও উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু অভিযানের দ্বিতীয় ধাপ আর শুরুই করতে পারেনি তারা।

বারিকবিল্ডিং থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত যেসব স্থাপনা তালিকাভুক্ত ছিল তার অনেকগুলো ছিল বন্দর কর্তৃপক্ষের। তাদের থেকে জায়গা লিজ নিয়ে কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে তোলা স্থাপনার মধ্যে আছে- ইন কনট্রেড ডিপো, শেখ আহমদ ডকইয়ার্ড, কাপ্তাই বোট বিল্ডার্স, নূসরাত জাহান ডকইয়ার্ড, নুর-ই-মদিনা ডকইয়ার্ড, সোনা মিয়া ডকইয়ার্ড, হাজি আব্দুল গণি ডকইয়ার্ড ও রশিদ অ্যান্ড কোং। এ প্রতিষ্ঠানগুলো কর্ণফুলীর প্রায় ১০০ একর তীর দখল করে জাহাজ তৈরি ও মেরামতের কাজ করছে।

এছাড়াও প্রভাবশালী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ রাইস মিল, বেঙ্গল আসাম রাইস মিল, দাদা সল্ট, কন্টিনেন্টাল এজেন্সিস, রাসেল অ্যান্ড ব্রাদার্স, এ কে খান অ্যান্ড কোং, কর্ণফুলী স্লিপওয়ে অ্যান্ড ডকইয়ার্ড, মেসার্স ইউরো শিপিং, আনোয়ারা অ্যাপারেলস, বিকন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, আবদুস সালাম অ্যান্ড ব্রাদার্স, মেসার্স আরেফা ট্রেডার্স ও বিএ অ্যান্ড ব্রাদার্স।

আদালতের নির্দেশনার পরও নদীতীরে নতুন করে টার্মিনাল নির্মাণের কাজও শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ কারণে অভিযানের দ্বিতীয় ধাপে গিয়ে পিছু হটতে থাকে তারা। আবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ছত্রছায়ায় ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় গড়ে উঠেছে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির মাছের আড়ত। অভিযোগ আছে, বন্দর থেকে অবৈধভাবে জায়গা লিজ নিয়ে সিটি মেয়রের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে এ আড়ত।

এদিকে জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে বাকলিয়ায় বাস্তুহারা সমবায় সমিতির নামে প্রায় ১০০ একর জায়গা দখল করে ভবন নির্মাণেরও অভিযোগ আছে। এসব কারণে হঠাৎ করেই থমকে গেছে উচ্ছেদ অভিযান। তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ সংশ্নিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ বলেন, 'কর্ণফুলী নদীতীরেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। এখানে আমাদের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আছে। আছে নতুন টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনাও। বন্দর বাঁচলে বাঁচবে পুরো দেশ। আবার চট্টগ্রামকে বাঁচাতে হলে রক্ষা করতে হবে কর্ণফুলীকেও। তাই বন্দরের নেতৃত্বে একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে। এটি চূড়ান্ত হলে কর্ণফুলীকে ফের দখল ও দূষণমুক্ত করার অভিযান শুরু হবে।'

এই উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

কর্ণফুলী দখলমুক্ত করতে হাইকোর্টে রিট করা আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, 'দুই হাজার ১৮১ স্থাপনা দখলমুক্ত করে ১৫৮ একর ভূমি পুনরুদ্ধার করতে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল আদালতের। মাস্টারপ্ল্যান করার অজুহাত দেখিয়ে আদালতের এ নির্দেশনা অমান্য করার কোনো সুযোগ নেই।'