জাতীয় ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০৬:৫৬

স্বপ্নের ইউরোপের পথে দুঃস্বপ্নের যাত্রায় ২ লাখ বাংলাদেশি

আমাদের কাগজ রিপোর্ট: অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে পদে পদে প্রতারণার শিকার হচ্ছে তরুণ-যুবকরা। দিনের পর দিন আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন, দেশে স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়, পাসপোর্টসহ সব কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে বিদেশবিভূঁইয়ের রাস্তায় ছেড়ে দেয়া, আটক করে জেল বন্দি জীবন কাটানো, সবশেষে সর্বস্ব খুইয়ে দেশে ফেরত আসার ঘটনা ঘটছে অহরহ।

অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি জমাতে দুই লাখের বেশি বাংলাদেশি দুবাইয়ে ঢুকেছে। করোনার আগে পরে এসব বাংলাদেশি ভিজিট ভিসায় সেখানে পৌঁছেছে। আর দুবাইকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে তারা অবৈধভাবে পাড়ি দিচ্ছে ইতালি, স্পেন, গ্রিস, ফ্রান্স, তুরস্কসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

বাস্তবতা হলো, এই মানুষগুলোর অধিকাংশই বিপদসংকুল এই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। দিনের পর দিন আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন, দেশে স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়, পাসপোর্টসহ সব কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে বিদেশবিভূঁইয়ের রাস্তায় ছেড়ে দেয়া, আটক করে জেল বন্দি জীবন কাটানো, সবশেষে সর্বস্ব খুইয়ে দেশে ফেরত আসার ঘটনা ঘটছে অহরহ।

তবু থেমে নেই উন্নত-সচ্ছল জীবনের আশায় অবৈধপথে বিদেশে পাড়ি জমানোর এই চেষ্টা। বেপরোয়া মানবপাচারকারী চক্রের ফাঁদে প্রতিনিয়ত পা রাখছে অসংখ্য তরুণ-যুবক।

বাংলাদেশ থেকে দালালের মাধ্যমে দুবাই হয়ে ইউরোপ যাওয়ার আগে মরক্কো, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, ইরান আলবেনিয়ার মতো দেশগুলোতে ঢুকছে তারা। আর ভয়ঙ্কর ঝুঁকির এই যাত্রাপথে তাদের অনেকেই মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে পাসপোর্ট, টাকাপয়সা সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। শিকার হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতনের। অনেক ক্ষেত্রেই তাদেরকে জিম্মি করে দেশে স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ।

ভয়ঙ্কর এসব ফাঁদ থেকে কোনোমতে মুক্তি মিললেও তাদের দেশে ফেরার পথ আর সেভাবে খোলা থাকে না। সব হারিয়ে ফেরার কোনো উপায় না দেখে আবার পা পাড়াচ্ছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর দিকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পারস্য উপসাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছাচ্ছে গ্রিস, স্পেন, ইতালি তুরস্কের মতো দেশে।

অভিবাসন বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশ করার জন্য ১৮টির মতো পথ ব্যবহার হয়। দুর্গম মরুভূমি গভীর সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছাতে প্রতিবছর বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। গ্রেপ্তার হয়ে জেল খাটতে হচ্ছে অনেককে।

পুলিশের একটি সূত্র বলছে, গত দুই বছরে বাংলাদেশ থেকে দুই লাখের বেশি মানুষ ভিজিট ভিসায় দুবাই গেছে। তাদের লক্ষ্য দালালদের মাধ্যমে ইউরোপের কোনো একটি দেশে পৌঁছানো। তবে এদের মধ্যে ঠিক কতজন ইউরোপে পৌঁছাতে পেরেছে বা পারছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই বাহিনীটির কাছে।

ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, কোভিডের আগে-পরে আমাদের দেশ থেকে প্রায় দুই লাখ লোক ভিজিট ভিসায় দুবাই গেছে। তাদের একটা বড় অংশই সেখানে কাজ পায়নি। সে সময়ই আমরা শঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম- এই যে লোকজন দুবাইয়ে যাচ্ছে, তারা পরবর্তীতে ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করবে।

তিনি বলেন, গত দুই বছরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে ২২ হাজারের বেশি মানুষ আটক হয়েছে। দুবাইয়ে ভিজিট ভিসায় যারা গেছে তারা এখন ইরান, গ্রিস, তুরস্ক হয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এতে করে শুধু তারা নিজেরাই যে বিপদে পড়ছে তা নয়, আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

উন্নত-সচ্ছল জীবনের আশায় অবৈধপথে বিদেশে পাড়ি জমানো প্রায় আড়াই হাজার বাংলাদেশি গত এক বছরে দেশে ফিরেছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সংস্থাটির মানবপাচার প্রতিরোধ টিমের তথ্য অনুযায়ী, মানব পাচারের শিকারদের একটা বড় অংশই দুবাই হয়ে অন্যান্য দেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে।

সম্প্রতি মানবপাচার মামলায় একটি চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ। চক্রটি ইউরোপে পাঠানোর নাম করে ভিজিট ভিসায় এক ভুক্তভোগীকে দুবাইয়ে পাঠায়। সেখানে তার পাসপোর্টসহ সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে পাঠায় ইরানে। সেখান থেকে পাঠানো হয় তুরস্কে।

তুরস্কে যাওয়ার পর সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে জেল খাটার পর আইওএম এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফিরে আসেন তিনি।

ভুক্তভোগীকে ভিজিট ভিসায় দুবাই এবং পরবর্তীতে ইরান তুরস্কে পাঠানো মানব পাচারকারী চক্রটির সঙ্গে সিভিল অ্যাভিয়েশনের একজনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। তারা হলেন- মাহামুদুল হাছান, জাহাঙ্গীর আলম বাদশা, সালামত উল্লাহ রাশিয়া বেগম।

তাদের মধ্যে মাহামুদুল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরে অগ্রগামী ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের এয়ার কন্ডিশন সার্ভিসে এবং জাহাঙ্গীর সিভিল এভিয়েশনে কর্মরত বলে জানিয়েছে সিআইডি।

তুরস্ক ফেরত এই ভুক্তভোগী বলেন, পাচারকারীরা জানিয়েছিল যে বিমানে করে আমাকে তুরস্কে পৌঁছানো হবে। সে জন্য প্রথমে যেতে হবে দুবাইয়ে। সেখান থেকে তুরস্কের ভিসা দেয়া হবে। কিন্তু তাদের কথা কাজে কোনো মিল নেই। পুরোটাই ছিল ফাঁদ।

তিনি বলেন, আমাকে দুবাই পাঠানো হয় ভিজিট ভিসায়। দুবাইতে যাওয়ার পরই আমার সঙ্গে থাকা টাকাপয়সা, পাসপোর্টসহ যাবতীয় ডকুমেন্ট নিয়ে যায় দালালেরা। কাগজ ছাড়া আমার কোথাও যাওয়ারও উপায় ছিল না।

তুরস্ক পাঠাবে বলে দুবাইতে আমার কাছ থেকে নেয়া হয় এক লাখ টাকা। তারা ট্রলার স্পিডবোটে করে আমাকে ইরানে নিয়ে যায়। সেখানে একটি কক্ষে আটকে রেখে ওরা আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। আমাকে নির্যাতনের বিষয়টি জানিয়ে দেশে আমার পরিবার থেকে দফায় দফায় ওরা লাখ টাকা আদায় করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ভুক্তভোগী আরও বলেন, শেষ পর্যন্ত অনেক টাকার বিনিময়ে আমি ইরান থেকে কোনো কাগজপত্র ছাড়া তুরস্কে পৌঁছাই। সেখানে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেল খাটি। এরপর বাংলাদেশ থেকে আউটপাস নিয়ে তুরস্কে বাংলাদেশ অ্যাম্বেসি আইএম-এর সহায়তায় দেশে ফিরে আসি।

সব হারিয়ে আমি আমার পরিবার এখন সর্বস্বান্ত, বিপর্যস্ত। আমি চাই না এমন ফাঁদে পড়ে কেউ অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করুক।

মানবপাচার ঠেকাতে সিআইডির টিম কাজ করছে জানিয়ে সংস্থাটির এই কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯ সালে ৭২টি মানবপাচার মামলার তদন্তভার পেয়েছি আমরা। এর মধ্যে ৬৭টির তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।

২০২০ সালে আমাদের কাছে এসেছে ৬৩টি মামলা আর প্রতিবেদন দিয়েছি ৫১টির। ২০২১ সালে তদন্তভার পেয়েছি ৫১টি মামলার, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি ৬০টির। আর ২০২২ সালে তদন্তভার পেয়েছি ৩০টির এবং তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে ৪৫টি মামলার।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, লিবিয়া, মরক্কো, ইরান, তুরস্ক কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোতে মানবপাচার হচ্ছে। দুবাইকে বিশেষ করে ট্রানজিট শহর হিসেবে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা।

মানুষ উন্নত জীবন উপার্জনের জন্য ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে যেতে প্রলুব্ধ হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা ভিজিট ভিসার মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো অন্যান্য আফ্রিকান দেশে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর