অপরাধ ও দুর্নীতি ৩১ মে, ২০২৩ ১১:০৯

ভুল ট্রেনে করে ঢাকায় এসে বিক্রি হয় অঞ্জনা, অবশেষে ৭ বছরের বন্দিজীবন শেষে মিললো মুক্তি

অঞ্জনা আকতার

অঞ্জনা আকতার

নিজস্ব প্রতিবেদক: ছোটবেলায় সিলেটের ভৈরবে কৌতূহলবশত ট্রেনে উঠেছিল মেয়েটি। ভেবেছিল ট্রেনটা ঘুরে তাকে এখানে নামিয়ে দেবে। কিন্তু এক সময় কমলাপুর রেলস্টেশনে নিজেকে দেখতে পান সেই সময়ের শিশু অঞ্জনা। মন খারাপ করে স্টেশনে বসে রইলেন। একজন তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শর্মি নামে এক মহিলার কাছে বিক্রি করে। তারপরে, মেয়েটি সেই মহিলার রান্নাঘরে সাত বছর কাটিয়েছিল। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সহায়তায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে মেয়েটির শরীরে শুধু আঘাতের চিহ্ন ছিল।

এখন তিনি তার বয়স সঠিকভাবে বলতে পারেন না। ঠিকানা কখনো সুনামগঞ্জ আবার কখনো হবিগঞ্জ। তার মনে আছে তার বাবা মারা গেছেন, কিন্তু পরিবারের কারো ঠিকানা জানা নেই।

আমরা গৃহকর্মী অঞ্জনা আখতারের কথা বলছি যাকে জাতীয় জরুরি পরিষেবা ৯৯৯ কল করে উদ্ধার করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি-ব্লকের ২ নম্বর সড়কের একটি বাসা থেকে অঞ্জনাকে উদ্ধার করে ভাটারা থানা পুলিশ।

বুধবার সন্ধ্যায় ভাটারা থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে ঠিকানা খোঁজার চেষ্টা করছেন। কিন্তু অঞ্জনার দেওয়া ঠিকানা মিলছে না।

থানায় বসে অঞ্জনা তার ওপর নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিল। তিনি বলেন, 'আমি সাত বছর ধরে রান্নাঘরে তালাবদ্ধ। এক সময় খাবার দিলে অন্য সময় দিতেন না। দিনরাত কাজ দেখেছেন। কোনো ভুল হলে কাঁটা চামচ, ছুরি, রুটির রোলার, ছুরি দিয়ে আঘাত করতেন। এমনকি সামনের দাঁতে তালা দিয়ে আঘাত করে ভেঙে ফেলেন।

অঞ্জনা তার হাত, পায়ে, বাহুতে, গালে এবং ঠোঁটে আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা করছিলেন। তার পা ফুলে গেছে, তার বাম বুড়ো আঙুলে রক্তাক্ত ক্ষত নির্যাতনের তীব্রতা নির্দেশ করে।

নির্যাতনের পাশাপাশি অঞ্জনা বলেন, আমাকে ঠিকমতো খাবার দিতেন না। অসুস্থ হলে ওষুধ দেননি। বরং শুয়ে থাকলে তাকে মারতেন। কাপড় দেননি। তাকে রান্নাঘর থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। কেউ আসলে বাড়িতে আটক ছিল.

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাড়ির তৃতীয় তলায় বসবাসকারী দম্পতি এরিক ও শর্মির বাসায় সাত বছর ধরে আটক ছিলেন অঞ্জনা। শর্মি অঞ্জনাকে পানীয় থেকে চুন সরানোর সময় নির্মমভাবে নির্যাতন করত। বিষয়টি নজরে আসে পাশের ভবনের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সজল শেখের। প্রথমে বিষয়টি গুরুত্ব না দিলেও অঞ্জনা একদিন তার ওপর করা নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে উদ্ধারের আবেদন জানায়। এরপর সজল তার বাড়ির অন্যদের ও বাড়ির মালিককে বিষয়টি জানায়। আজ ভোর ৫টায় সজল পড়তে উঠে দেখল অঞ্জনা তখনও কাজ করছে। কারণ, বাড়িতে অতিথি আসবেই। রাতভর কাজ করা অঞ্জনাকে রাতে শুধু সাদা ভাত খেতে দেওয়া হয়। এ সময় তিনি ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ৯৯৯ এ ফোন করে বিষয়টি জানান এবং উদ্ধারের অনুরোধ জানান। পরে পুলিশ গিয়ে দুই ঘণ্টা চেষ্টার পর তাকে উদ্ধার করে।

উদ্ধারকারীদের নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে সজল বলেন, 'মানবিক কারণে মেয়েটিকে উদ্ধারে এগিয়ে এসেছি। মেয়েটিকে সবসময় রান্নাঘরে দেখতাম। যখনই দেখি এটা দিনরাত কাজ করে। এমনকি আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি এটা কাজ করছে। পরে বিষয়টি ৯৯৯ নম্বরে জানান। পুলিশের কাছে যাওয়ার পরও এই নারী নিজের নাম ও পরিচয় ভুলভাবে দিয়েছেন। তার বাড়িতে কোনো কাজের মেয়ে নেই। পরে মেয়েটি চিৎকার করলে পুলিশের সামনেই তাকে মারধর করা হয়।

গৃহকর্মী নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে শর্মি বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কোনো অত্যাচার করিনি। মেয়েটি (অঞ্জনা) মানসিকভাবে অসুস্থ। রেগে গেলে নিজেকে কষ্ট দিত।'

গৃহকর্মী উদ্ধারের বিষয়ে ভাটারা থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, 'আজ সকালে ৯৯৯ নম্বরে কল পেয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করি। তার ঠিকানা খোঁজা হচ্ছে।

নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে ওসি বলেন, 'আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। অভিযোগ পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আমাদেরকাগজ/এইচএম