জাতীয় ২২ মার্চ, ২০২৩ ১২:২৫

পানির স্তর নিচে নেমে গেছে অর্ধেক জেলায়, ভয়াবহতার সামনে দেশ

আমাদের কাগজ রিপোর্ট: ১৯৬৮ সালে যখন দেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো শুরু হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ ফুট নিচে টিউবওয়েল বসিয়েই পানি পাওয়া যেত। এখন ১৬০ ফুট বসিয়েও পর্যাপ্ত পানি মিলছে না। অযৌক্তিক আহরণ ও মানব সৃষ্ট দূষণে রাজধানীতে পানির স্তর নিচে নেমে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এমনকি বিভিন্ন তথ্যমতে দেশের প্রায় অর্ধেক জেলায় নানা কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে স্তর নিচে নেমে যাওয়া অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে দেশের মানুষ ভয়াবহ পানির সংকটে পড়বে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আজ বুধবার বিশ্ব পানি দিবস। এবারের পানি দিবসের প্রতিপাদ্য ‘পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে ত্বরান্বিত পরিবর্তন’। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনের এজেন্ডা ২১-এ প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবটি তোলা হয়। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভা ২২ মার্চ তারিখটিকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ওই বছরই প্রথম পানি দিবস পালিত হয় এবং তারপর থেকে এই দিবস পালনের গুরুত্ব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এ দিনটি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করে।

শরীরকে সচল রাখা ও শারীরিক ফিটনেস অর্জনে খাদ্য তালিকায় প্রচুর বিশুদ্ধ পানি থাকতে হয়। প্রতিদিন অন্তত আট গ্লাস পানি পান করা উচিত। প্রয়োজনীয় পানি পানের অভাবে পানিশূন্যতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনির সমস্যা, শরীরে টক্সিন জমাসহ অনেক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র পানি সংকট। বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী পানি সংকটের মধ্যে রয়েছে। আর সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে বিশ্বের ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ।

দেশে বর্তমানে অন্তত ৬০ লাখ গভীর, অগভীর ও অন্যান্য নলকূপ ব্যবহার হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে পাতালের পানির স্তর নেমে গেলে অন্তত ১৫ লাখ নলকূপ অকেজো থাকে। এ অবস্থায় নলকূপের পানি উত্তোলনের জন্য শ্যালো ইঞ্জিন মাটি খুঁড়ে অনেকটা নিচে বসাতে হয়। খুলনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ উপকূলের ১৬ জেলার কোনোটিতেই পর্যাপ্ত সুপেয় পানি নেই। সবখানেই লবণজলের আগ্রাসন। ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে তাই এক কলস পানি কিনে আনতে হয় ১০ টাকা দিয়ে। খাবার পানি জোগাড় করতেই উপকূলের নারীদের দিন কেটে যায়। অনেক এলাকার নলকূপের পানিতে আবার রয়েছে আর্সেনিক।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৭ লাখ ৫০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়, যার ৮০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করা হয়। মাটির ওপরের উৎস থেকে বাকি চাহিদা মেটানো হয়।

অধিদপ্তরের গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান কালবেলাকে বলেন, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ পানি চাষাবাদে ব্যবহার হয়। বাকি চাহিদার ৬ শতাংশ শিল্প ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতে এবং ৪ শতাংশ ব্যবহার হয় পান করা ও গৃহস্থালি কাজের জন্য। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০০ ফুট গভীর পর্যন্ত গভীরতায় পানি উত্তোলনের কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে।

গত বছর জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের শীর্ষে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম রয়েছে। তালিকায় সপ্তম স্থানে বাংলাদেশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশ বছরে ৩০ ঘন কিলোমিটার এলাকা থেকে পানি উত্তোলন করেছে এবং ৮৬ শতাংশ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করেছে।

বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের হিসেবে, সুপেয় পানি পাচ্ছে না দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। উপকূলীয় অঞ্চলে এখনই ১০ কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। দেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সী কমপক্ষে ৪ হাজার ১০০ শিশু মারা যায় নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধার অভাবে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মধ্যভাগ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত ৪৮ জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ ও খাবার পানি সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিএডিসির গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠের ১৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঢাকার ভূ-স্তরের উচ্চতা ৫০ ফুট। সেই হিসেবে ঢাকায় পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় মাটির নিচ থেকে অব্যাহতভাবে পানি তোলা হলে আগামীতে ঢাকার পানিতে সমুদ্রের লবণপানি চলে আসবে।

গবেষকরা বলছেন, এক যুগ আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলে ৬০ থেকে ৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে ১৬০ ফুট বা তার নিচে না গেলেও পানি মিলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০ থেকে ৪৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। পানির অভাবে ফসলের আবাদ বন্ধ হয়ে গেছে বরেন্দ্র এলাকার অনেক উপজেলায়। রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পানির স্তর নামছে। বর্ষা মৌসুমেও এ স্তর স্বাভাবিক অবস্থায় আসছে না। বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরোর চাষ প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেলেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমে নামছে। পানির স্তর এভাবে নামার পেছনে কারণ বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়া, বৃষ্টির তীব্রতার পরিবর্তন, ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, জলাশয় কমে যাওয়া, পানি পুনর্ভরণ এলাকা কমে যাওয়া এবং শুকনা মৌসুমে নদীর পানির কম প্রবাহ।

ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী। সুপেয় পানির চাহিদার শতকরা ৭৮ শতাংশ গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করছে ঢাকা ওয়াসা। ১৯৭০ সালে ৪৯টি গভীর নলকূপ ছিল ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে। এখন ৯০৬টি নলকূপ ব্যবহার হচ্ছে। সিটি করপোরেশন এলাকায় গভীর নলকূপ বসানোর নিয়ম না থাকলেও ক্রমান্বয়ে তা বাড়ছে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিচে নামছে পানির স্তর।

ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় ওয়াসার গ্রাহক সংখ্যা তিন লাখের বেশি। প্রতিদিন পানির চাহিদা মেটাতে ২৬০ থেকে ২৬৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে সংস্থাটি। এর মধ্যে ৩৪ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে সংগ্রহ করা।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম গত জানুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদে বলেন, বর্তমানে ঢাকা শহরের গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এলাকাভেদে ৩৮ মিটার থেকে ৮২ মিটার। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর ২ থেকে ৩ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। ঢাকায় ৬৬ শতাংশ ভূগর্ভস্থ এবং ৩৪ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের হার ৮ শতাংশ এবং ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের পরিমাণ ৯২ শতাংশ। চট্টগ্রাম শহর এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির গড় অবস্থান ১০০ মিটার এবং প্রতিবছর প্রায় ৩ মিটার পানির স্তর হ্রাস পাচ্ছে।

এভাবে পানির স্তর নামতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়বে। শহর, গ্রাম এবং শিল্প এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমিয়ে বৃষ্টি বা উন্মুক্ত জলাধারের পানির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে পানির প্রাপ্যতা কমে যাবে। সুপেয় পানির সংকট দেখা দেবে। নরম মাটির ক্ষেত্রে ফাটল ও দেবে যাওয়ার ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের মূল অংশ বাদে আশপাশের নিচু এলাকার ক্ষেত্রে ভূমি দেবে যেতে পারে। আর নদী এলাকার ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে ভূমিতে ফাটল দেখা দেয়।

বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, নদীমাতৃক বাংলাদেশে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক নানাবিধ কারণে পানীয় জল ও স্যানিটেশনের সংকট বিদ্যমান। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার নদী ও খাল পুনর্খনন, প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষণাবেক্ষণ এবং নতুন জলাধার ও ব্যারাজ নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, প্রতিটি পানির ফোটার সর্বোত্তম ব্যবহারই নিশ্চিত করতে পারে সার্বজনীন পানি প্রাপ্যতা, পানির ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জনের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ পানি ব্যবস্থাপনা, স্যানিটেশন, কৃষিকাজ, শিল্প খাত ও বাস্তুচ্যুত বজায় রেখে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পানি চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে। জাতীয় পানি নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পানি ব্যবস্থাপনার নিয়মনীতি ও মানের নিরিখে উন্নয়নগামী দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চাহিদার সমন্বয় সাধনে সক্ষম হয়েছে।

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর