অপরাধ ও দুর্নীতি ১৩ মার্চ, ২০২৩ ১০:৫৪

এক বছরে ঢাকায় নিখোঁজ হওয়া ৫,৯৩৭ জনের ভাগ্যে কি ঘটেছে?

আমাদের কাগজ রিপোর্ট: রাজধানীর কদমতলী হাইস্কুল রোডে পরিবার নিয়ে থাকতেন সেলিম সরকার। ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট বাসার পাশে মসজিদে নামাজ আদায় করতে গিয়ে তিনি আর ফেরেননি। স্ত্রী আয়েশা বেগম এবং চার সন্তান গত সাড়ে তিন বছরে সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজেও তাঁর সন্ধান পাননি। সেলিম (৬৫) নিখোঁজ হওয়ার দিনই তাঁর ছেলে মো. শিপলু কদমতলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি বা জিডি (নং ১৩৭৬) করেছিলেন। কিন্তু সে বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে কি না, জানেন না কদমতলী থানার ওসি প্রলয় কুমার সাহা। তিনি বলেন, ‘সেলিম সরকার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আপনার কাছে প্রথম শুনলাম। ঘটনার সময় আমি এই থানায় ছিলাম না।’

মো. শিপলু বলেন, ‘বাবা ব্যবসা করতেন। প্রতিদিনের মতো মসজিদে গেলেও আর ফিরে আসেননি। আমরা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজেছি। এলাকায় মাইকিং করেছি। কোথাও লাশ উদ্ধার হলে দৌড়ে গেছি। বিভিন্ন মর্গেও খোঁজ নিয়েছি। কোথাও বাবার খোঁজ পাইনি। বাসার কাছ থেকে বাবা কীভাবে হারিয়ে গেছেন, তা মাথায় আসছে না।’

বেশ কিছু পরিবারের অভিযোগ, নিখোঁজ হওয়ার পরপরই পুলিশকে জানালেও পুলিশের তৎপরতা শুরু হয় দেরিতে। কোনো কোনো ঘটনার তদন্তও হয় না। 

গত ২৭ জানুয়ারি বিকেলে রাজধানীর ওয়ারী থানার ভজহরি সাহা স্ট্রিটের নিজ বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন মো. সাহিদ খান (৫৫)। স্ত্রী নাসরিন বেগম সন্তানদের নিয়ে স্বামীকে খুঁজে চলেছেন। তিনি ২৮ জানুয়ারি ওয়ারী থানায় জিডি (নং ১৩৩১) করেন। নাসরিন বলেন, ‘২৭ জানুয়ারি বিকেলে সাহিদ খান বাসা থেকে বেরিয়ে যান। রাতে বাসায় ফেরেননি। এক দিন অপেক্ষা করে ওয়ারী থানায় জিডি করি। পুলিশ এখনো খোঁজ দিতে পারেনি।’

জিডির তদন্ত কর্মকর্তা ওয়ারী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আসাদ বলেন, ‘নিখোঁজ ব্যক্তির সর্বশেষ লোকেশন ছিল যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে। এরপর মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। আমরা চেষ্টা করছি তাঁকে খুঁজে বের করার।’

ঢাকায় বছরে নিখোঁজ ৫,৯৩৭ জন

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০ থানায় প্রতিদিন গড়ে ১৬ জনের বেশি নিখোঁজ হওয়ার জিডি হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ডিএমপির থানাগুলোতে এ ধরনের ৫ হাজার ৯৩৭টি জিডি হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ১৬ জন নিখোঁজ হয়েছে এই সময়ে। ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি জিডি হয়েছে ডিএমপির মিরপুর বিভাগে। এই বিভাগের আট থানায় এক বছরে ১ হাজার ৪৪৪ জন নিখোঁজ হয়েছে। সবচেয়ে কম নিখোঁজ রমনা বিভাগে। এই বিভাগের ছয়টি থানায় এক বছরে ২৫৬ জন নিখোঁজ হয়েছে।

জয়পুরহাট থেকে স্বামী মশিউর রহমান মঞ্জুর সন্ধানে ঢাকার পল্লবীতে এসেছেন মামুনী নিশাত বৃষ্টি। ঢাকায় এসে জানতে পারেন, ৩০ জানুয়ারি রাতে মঞ্জু পল্লবী থেকে নিখোঁজ হন। বৃষ্টি জানান, ঢাকার কোথাও তার স্বামীর সন্ধান মেলেনি। পল্লবী থানায় তিনি জিডি করেন। পুলিশ তদন্ত করে মঞ্জুর মোবাইল ফোনের সর্বশেষ অবস্থান পেয়েছে কক্সবাজারে। এরপর আর খোঁজ নেই।

ডিএমপির কাছে নিখোঁজ মানুষের পরিসংখ্যান থাকলেও তাঁদের মধ্যে কতজনকে খুঁজে পাওয়া গেছে অথবা কার ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেই তথ্য নেই। নিখোঁজ মানুষের খোঁজ পাওয়ার বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য জানতে চাইলে ডিএমপির জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন বলেন, ‘নিখোঁজদের ফিরে আসার এ রকম তথ্য ডিএমপি সংরক্ষণ করে না।’

যেসব কারণে নিখোঁজ হওয়ার জিডি

কাউকে খুঁজে না পেলে স্বজনেরা থানায় জিডি করেন। এ ছাড়া কারও গৃহকর্মী, গাড়িচালক, নিরাপত্তাকর্মী হঠাৎ উধাও হলে; এতিমখানা বা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ না বলে চলে গেলে, প্রেম বা অন্য কোনো কারণে নারী বা পুরুষ হঠাৎ উধাও হলে, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মানুষ ও শিশু হারিয়ে গেলে, কেউ অপহৃত হলে জিডি হয়। এ রকম ১০-১৫টি কারণে নিখোঁজ-সংক্রান্ত জিডি হয় বলে জানিয়েছে ডিএমপি।

ঢাকায় নিখোঁজ মানুষের মধ্যে সবাইকে ফিরে পাওয়া যায় কি না, জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনারই তদন্ত হয়। অনেকে ফিরে আসেন। তবে এ মুহূর্তে বলতে পারছি না কতজন ফিরেছেন।’

লাশ মেলে অনেকের

বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ গত বছরের ৪ নভেম্বর রামপুরা থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় রামপুরা থানায় জিডি হয়েছিল। পরে শীতলক্ষ্যা থেকে ফারদিনের লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দুরন্ত বিপ্লব নিখোঁজ হওয়ার পর ৯ নভেম্বর তাঁর ছোট বোন শাশ্বতী বিপ্লব জিডি করেন। ১৩ নভেম্বর বুড়িগঙ্গা থেকে দুরন্তের লাশ উদ্ধার হয়। স্বজনেরা পরিচয় শনাক্ত করেন।

বেওয়ারিশ হিসেবেও দাফন

প্রতিদিন ১৬ জন নিখোঁজ হওয়ার এই শহরে দুটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে ঢাকায় তারা ৪৪৩টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। এদের পরিচয় শনাক্ত হয়নি।

ঢাকায় নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের সংখ্যাও। তাই নিখোঁজ হওয়ার সব ঘটনা গুরুত্বসহ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান। তিনি বলেন, কোনো নাগরিক নিখোঁজ হলে তাঁকে না পাওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা উচিত।

১৫ শতাংশ হত্যার শিকার

বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে থানা-পুলিশের পাশাপাশি কাজ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সংস্থাটির সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৩ হাজার ২৯৬টি অচেনা লাশের মধ্যে পিবিআই ৭৬৭ জনের পরিচয় শনাক্ত করেছে। ২ হাজার ৫২৯ লাশের পরিচয় অজানাই থেকে গেছে। শনাক্ত লাশের ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ হত্যার শিকার।

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনাই আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। এসব ঘটনা তদন্তে একজন কর্মকর্তাকে বহুদিন লেগে থাকতে হয়। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, যাতে বেওয়ারিশ লাশের পরিচয় ও মৃত্যুর কারণ জানা যায়। সে জন্য প্রযুক্তিগত ও প্রথাগত—দুভাবেই তদন্ত করি।’ সূত্র: আজকের পত্রিকা

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর