রাজনীতি ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১০:১৩

ফের আলোচনা-সমালোচনার মুখে ছাত্রলীগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ফের আলোচনা-সমালোচনার মুখে ছাত্রলীগ। কিছু নেতাকর্মীর অসংলগ্ন ও বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে জাতির পিতার নিজ হাতে গড়া সংগঠনটি। বেপরোয়া এসব নেতাকর্মীকে কিছুতেই যেন বাগে আনতে পারছে না সংগঠনটির নতুন নেতৃত্ব। রাজনীতি সচেতন মহল বলছে এখনই এদের রাশ টানতে না পারলে ভবিষ্যতে আরো খারাপ পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।

রাজধানীর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ উঠছে। বেসামাল কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ইতোমধ্যেই প্রায় ২১ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমনকি নিপীড়নবিরোধী সমাবেশ কর্মসূচি পালন করেছে ছাত্রলীগ।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক), সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা ইডেন কলেজ, ময়মনসিংহে আনন্দ মোহন কলেজসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ উঠেছে।

ঢাকার বাইরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে র‌্যাগিংয়ের নামে বিবস্ত্র করে রাতভর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়টি দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। যদিও ইতোমধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফুলপরীকে নির্যাতনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরীসহ পাঁচজনকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে তাকে নির্যাতন করার অভিযোগ করেন ফিন্যান্স বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরী খাতুন। ভুক্তভোগী ছাত্রী ফুলপরীর ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তার অনুসারীরা তাকে নির্যাতন করেন। নির্যাতনের সময় তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল ও ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হলের প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। এ ঘটনায় রিট হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের পাশাপাশি কিছু নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।

ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি করে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন রোববার জমা দেয়া হয়। অন্যদিকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুন্সি কামরুল হাসানকে আহ্বায়ক করে দুই সহসভাপতি বনি আমিন ও রাকিবুল ইসলাম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক জাকির হোসেনকে কমিটির সদস্য করা হয়। তদন্ত কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল।

অপরদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে কৃষ্ণ রায় নামে এক ছাত্রকে হলের কক্ষে আটকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) প্রধান ছাত্রাবাসে ‘শিবির সন্দেহে’ চার শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

এছাড়া পুরান ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে এক ছাত্রী ছাত্রলীগ নেতার কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন। ওই ছাত্রী ঘটনার বিচার চাইলে উল্টো তাকে ডেকে নিয়ে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুল ইসলাম আশিক ধর্ষণের হুমকি দেন।

এসব ঘটনায় ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তাদের মধ্যে প্রায় ২১ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কার হওয়া নেতাকর্মীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ১৫ জন, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ৩ জন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ১ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ১ জন ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ শাখার ১ জন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বহিষ্কৃতরা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক মানবসম্পদবিষয়ক উপসম্পাদক নাজমুল হাসান রুপু; কবি জসিম উদদীন হল শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানজীর আরাফাত তুষার; ফজলুল হক হলের সমাজসেবা সম্পাদক আসাদুল্লাহ আসাদ, পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মাহিদুর রহমান বাধন, গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ পলক, উপদপ্তর সম্পাদক জিহাদুল ইসলাম, অর্থবিষয়ক উপসম্পাদক আল কাউসার, গ্রন্থনা ও প্রকাশনাবিষয়ক উপসম্পাদক শাওন চৌধুরী; মাস্টার দা সূর্যসেন হলের সদস্য ফাহিম তাজওয়ার জয় ও সাজিদ আহমেদ, মো. তারেক (ফজলুল হক হল), রাহুল রায় (জগন্নাথ হল), ফজলে নাবিদ সাকিল, সাদিক আহাম্মদ ও মো. রাহাত রহমান (বিজয় একাত্তর হল)।

এ ছাড়াও বহিষ্কৃত হয়েছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক অসিত পাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মারুফ ইসলাম, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসম্পাদক শাহ আলম রাতুল, কর্মী নূর মোহাম্মদ নাবিল ও কামরান সিদ্দিক রাশিদ এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ শাখার রাকিবুল ইসলাম রাকিব।

নেতাকর্মীদের বহিষ্কার করার পাশাপাশি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে র‍্যাগিং ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) নির্যাতনের শিকার সেই ছাত্রীকে স্যালুট জানিয়ে বলেন, যৌন হয়রানি ও র‌্যাগিংবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক ফুলপরী। ফুলপরীকে আমরা স্যালুট জানাই। নিপীড়কের যে দলীয় ক্ষমতার পারিবারিক পরিচয় থাকুক না কেন, ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে সব ভেঙে যাবে।

ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে, আলিয়া ও কওমি মাদরাসা, স্কুল-কলেজের ঘটে যাওয়া ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন ও হতাশ করে। সেই সব নিরসনই আমাদের যাত্রা। কথার ফুলঝুরি ছুটানো বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একমাত্র লক্ষ্য নয়। আমরা সমস্যা মোকাবিলা এবং শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে জানি।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেছেন, ছাত্রলীগে দুর্বৃত্তদের কোনো স্থান নেই। ছাত্রলীগ নিয়মতান্ত্রিক আদর্শের সংগঠন। ছাত্রলীগ তার সাংবিধানিক নিয়ম-কানুন মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনার দেখানো পথে সামনের সৈনিক হিসেবে কাজ করবে, ধারক হিসেবে কাজ করবে, সুন্দর, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে। ছাত্রলীগের নাম বদনাম করে কেউ পার পাওয়ার সুযোগ নেই।

নেতাকর্মীদের বহিষ্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, বহিষ্কার করেছি। অপরাধ প্রমাণিত হলে ভবিষ্যতে তাকে বহিষ্কার করব। আমরা চাই ছাত্রলীগ তার অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করুক।


আমাদেরকাগজ/এইচএম