আমাদের কাগজ রিপোর্ট: সাইফুল ইসলাম পেশায় চাকুরিজীবি। কাজ করছেন একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান। গ্রামের বাড়িতে পরিবার থাকার সুবাদে প্রতি সপ্তাহের শেষদিনে চলে যেতে হয় কুমিল্লায়। অনেকটা আক্ষেপের সুরেই বলছিলেন ‘ আগে কাচপুর ব্রিজ পার হলেই বাতাস টা কেমন যেন হালকা লাগত; নিঃশ্বাস নিতে শান্তি পেতাম। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই ভাই, ঢাকার মত অবস্থা বাড়িতেও। পুরো রাস্তা মাস্ক পড়ে বসে থাকতে হয়, সেই শান্তির নিঃশ্বাসটা নিতে পারি না।
সাইফুল ইসলামের সেই শান্তির নিঃশ্বাস কোথায় হারালো সেই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে জানা গেলো চার বছর আগেও দেশের সবচেয়ে কম বায়ু দূষণের জেলা ছিলো কুমিল্লা; কিন্তু এখন ‘সবুজ আর স্বাস্থ্যকর’ এই নগরীর ‘বিষ’ সারাবিশ্বকে টপকে জনস্বস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে।
২০১৯ সালের জুন মাসে পরিবেশ অধিপ্তরের বায়ুমান মানমাত্রা মনিটরিং স্টেশনের তথ্যে জানানো হয়েছিলো, কুমিল্লা দেশের সবচেয়ে কম বায়ু দূষণের জেলা। দূষক প্যারামিটার পিএম ২ দশমিক ৫ ধরে করা হিসাব অনুযায়ী, তখন নগরীর বায়ু দূষণের মাত্রা ২৭। একই সময় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (বায়ুমান মানমাত্রা) অনুযায়ী, রাজধানীর বায়ু দূষণের মাত্রা ছিলো ১১৫।
বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘আইকিউ এয়ার’ বিশ্বের প্রায় ১০০টি বড় শহরের বায়ুদূষণ নিয়ে লাইভ প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। সেই তালিকায় ১৮ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা ছিল সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে। এ দিন বায়ুমান সূচকে কুমিল্লার মান ছিল ২৮৯।
এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল ২৮১। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বায়ুমান ছিল ১৭২। চলতি মাসের ২৩ দিনের মধ্যে ১৩ দিনই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এই নগরীর বায়ুমান ছিল ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। আট দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি তালিকায় ১৬৪ স্কোর নিয়ে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় রাজধানীর অবস্থান ছিলো অষ্টম। আর রাজধানীকে ছাড়িয়ে কুমিল্লার দূষণমাত্রা বলা হয়েছে ১৭৩।
মাত্র চার বছরের মধ্যে বায়ুমানের অবনমন ভাবাচ্ছে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে। তারা মনে করেন, জনস্বাস্থ্যের হুমকি মোকাবিলায় বায়ু দূষণ কমাতে এখনই কঠোর হতে হবে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রশাসনকে। যদিও পরিবেশবিদদের অনেকেই এই তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
কুমিল্লায় দিনের চেয়ে রাতে বায়ু দূষণ বেশি থাকে উল্লেখ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের কুমিল্লার উপ-পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মুহাম্মাদ রাজীব বলেন, “২০১৯ সালে আমাদের প্রতিষ্ঠানের তথ্যে, কুমিল্লা সবচেয়ে কম দূষণের জেলা ছিলো। তবে বর্তমানে যেটা বলা হচ্ছে, এই তথ্য কতোটা সঠিক সেটা আমার এই মুহূর্তে জানা নেই। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।
“আমরা বায়ুদূষণ রোধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছি। সামনে আমরা আরও কঠোর হব। ইটভাটার পাশাপাশি নির্মাণকাজের ধুলা ও যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার কুমিল্লা জেলার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “কীভাবে কুমিল্লাকে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের জেলা বলা হলো সেটা আমার মাথায় আসে না। আমার কাছে এই তথ্য সঠিক মনে হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, “তবে অতীতের তুলনায় কুমিল্লায় বাষু দূষণ বেড়েছে। সরকারি দপ্তরগুলোকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি বায়ু দূষণ রোধে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে।”
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইড, লেড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও প্রলম্বিত বস্তুকণার কারণে বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।
বাতাসের একিউআই মাত্রা শূন্য থেকে ৫০ পিপিএম হলে তাকে ‘সবুজ বা স্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। একিউআই মাত্রা ৫১ থেকে ১০০ পিপিএম হলে তাকে 'মধ্যম' বায়ু বলা হয়, যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়।
মাত্রা ১০১ থেকে ১৫০ পিপিএম হলে সে বায়ুকে 'সতর্কতামূলক' বায়ু বলা হয়, যেটা মানুষের জন্য মৃদু ক্ষতিকর। আর একিউআই মাত্রা ১৫১ থেকে ২০০ পিপিএম হলে সে বায়ুকে 'অস্বাস্থ্যকর' শ্রেণিতে ফেলা হয়।
২০১ থেকে ৩০০ পিপিএম একিউআই মাত্রার বাতাসকে 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' শ্রেণিতে এবং ৩০১ থেকে ৫০০ পিপিএম মাত্রার বাতাসকে ‘চরম পর্যায়ের অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
কুমিল্লায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরেও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও সামাজিক সংগঠন পরিবেশ নিয়ে কাজ করে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত চার বছরে জেলায় সড়ক-মহাসড়কে প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। এসব কাজ করার ক্ষেত্রে পরিবেশের দিকে যে নজর দেওয়ার কথা ছিল সেটি দেওয়া হয়নি।
কুমিল্লা জেলায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩০০ ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটার বেশিরভাগই গড়ে উঠেছে পরিবেশ আইন না মেনে।
দেশের ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা পড়েছে কুমিল্লা জেলায়। এ ছাড়া রয়েছে কুমিল্লা-নোখায়ালী, কুমিল্লা-চাঁদপুর ও কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক। এসব মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন অর্ধ লক্ষাধিক গাড়ি চলাচল করে। যানবাহনের কালো ধোঁয়া কুমিল্লার বায়ু দূষণ বাড়িয়েছে।
মহাসড়কে যানবাহনের কালো ধোঁয়া, কুয়াশার কারণে ধূলির স্তর নিচে নেমে আসাসহ বিভিন্ন কারণে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এসবের বাইরেও শীতকাল বা শুষ্ক মৌসুমে ধূলিকণা বাড়ে।
এ ছাড়া অবাধে পুকুর ভরাট, নদী, নদীর চর ও কৃষি জমি অবাধে কেটে মাটি পরিবহনের সময় ধুলোবালিতে সড়ক পথে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। লালমাই পাহাড় কেটে গাছপালা সাবাড় করে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন অনেকেই।
কুমিল্লা নগরীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নার্সিংয়ের শিক্ষার্থী পুতুল আক্তার রলি স্কুটারে চলাচল করেন।
তিনি বলেন, “কুমিল্লার সর্বত্রই বায়ু দূষণ বেড়েছে। বিশেষ করে নগরীতে মাস্ক ছাড়া চলাচল করলে নাক যেন বন্ধ হয়ে আসে। ধুলাবালুতে চলাচল করা কষ্টকর। একটি জামা একবারের বেশি পরা যায় না; কারণ বের হলেই ধুলাবালুতে ভরে যায়।”
নগরীর শাসনগাছা এলাকার বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন বলেন, “বায়ু দূষণ বেড়ে যাওয়ায় মানুষের চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এদিকে খুব একটা লক্ষ্য করছে না। যার কারণে যে যার ইচ্ছেমতো বায়ু, পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে চলছে। আমাদের এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে ধুলাবালুর কারণে চলাচল মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।“
জাতীয় পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত কুমিল্লার দাউদকান্দির কৃষি ও পরিবেশ সংগঠক মতিন সৈকত বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান, পৌরসভা, হাট-বাজারের ব্যবসায়ী এমনকি সাধারণ মানুষও অবাধে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে একাকার করে ফেলেছে। এসবের দুর্গন্ধে মানুষের চলাচল করতে কষ্ট হয়। প্রায় সময় দেখি ময়লার ভাগাড়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এতে চরমভাবে বায়ু দূষণ হচ্ছে।
তিনি বলেন, “বালু, সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ঢাকা হচ্ছে না। নিজেদের সুরক্ষার জন্য হলেও বায়ু দূষণ রোধে আমাদেরকে এখনই সচেতন হতে হবে।”
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি রোকেয়া বেগম শেফালী বলেন, “আমি অবাক হয়েছি, তিন বছরের মধ্যে কীভাবে কুমিল্লা বায়ু দূষণে সবচেয়ে ভালো থেকে খারাপের জেলায় পরিণত হয়েছে। গোমতী নদীর বালু ও নদী চরের মাটি অবাধে লুটে নেওয়া হচ্ছে। গোমতীর দুই পাড়ের সড়কে মাটি পরিবহনের ধুলোবালির কারণে মানুষের চলাচল দায় হয়ে পড়েছে।
“কুমিল্লা ইপিজেডের বিষাক্ত তরল বর্জ্য খাল-বিলে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব কারণে কুমিল্লায় বায়ু দূষণ চরম আকার ধারণ করেছে। সড়কে নির্মাণকাজের সময় পানি ব্যবহার করা হয় না। যার কারণে বায়ু দূষণ আরও বাড়ছে।”
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, “বায়ু দূষণ বেড়ে গেলে জনস্বাস্থ্যের জন্য এটি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের ফুসফুস, চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, কানে কম শোনা, বিভিন্ন চর্মরোগ হওয়া, লিভার-কিডনির সমস্যা এবং সব শেষে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়। তাই মানুষকে ঘরের বাইরে চলাচলের সময় অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।”
আমাদের কাগজ/টিআর