স্বাস্থ্য সেবা ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০৫:৩৭

কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরির ৬১ বছরের দীর্ঘ যাত্রা, সফলতা কতদূর?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড যা কিনা আসল হৃৎযন্ত্রের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারবে! বিজ্ঞানীরা অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে এমন হৃৎপিণ্ড তৈরির চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখনো পুরোপুরি সাফল্যের দেখা মেলেনি। বিস্তারিত জানিয়েছে দ্য এমআইটি প্রেস রিডার।

১৯৬৪ সালে মার্কিন কার্ডিওভাসকুলার সার্জন মাইকেল ডিবেকি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসনকে ধরে স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরির জন্য একটি তহবিলের ব্যবস্থা করেন।

১৯৬৯ সালে টেক্সাস হার্ট ইনস্টিটিউট প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ কৃত্রিম একটি হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়। এর তিন মাস পরে অ্যাপোলো ১১ মহাকাশে পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র।

চন্দ্রাভিযান আর কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরির গবেষণা যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় একই সময়ে শুরু হয়। কিন্তু চাঁদে মানুষের পদার্পণ, স্পেস শাটল বা আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ইত্যাদি অর্জন মানুষ করতে পারলেও এখনো সফল কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরির কাজে বিশেষ সাফল্য পাননি বিজ্ঞানীরা।

শুরুর দিকে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড যেন স্বাভাবিক হৃৎপিণ্ডকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপিত করতে পারে, তা চিন্তা করে কাজ করেছিলেন গবেষকেরা। প্রথম কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডের একটি বাহ্যিক কমপ্রেসর ও বায়ু চলাচলের একটি নল ছিল। নলটি রোগীর শরীরের ভেতরে প্রবেশ করানো থাকত।

ওই কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডে বাতাসের সাহায্যে ড্যাক্রন ব্যাগকে সংকুচিত ও প্রসারিত করা হতো। আর এ সংকোচন-প্রসারণ পাশের আরেকটি থলে থেকে রক্তকে শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করত। এ কমপ্রেসরটি রোগীর শরীরের বাইরে থাকত।

কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড ও হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন- এ দুটোর ইতিহাস একে অপরের সঙ্গে জড়িত। ১৯৬৭ সালে কেপ টাউনে কার্ডিয়াক সার্জন ক্রিস্টিয়ান বার্নার্ড প্রথম সফলভাবে হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করেন। এর ফলে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডের উদ্দেশ্যে বড়সড় পরিবর্তন আসে।

কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড রোগীর দেহে আমৃত্যু কাজ করবে— এমনটাই ছিল এটি তৈরির প্রাথমিক উদ্দেশ্য। কিন্তু ১৯৬৭ সালের পর প্রতিস্থাপনযোগ্য হৃৎপিণ্ড খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত কাজ করতে পারাটাই কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডের প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে উঠল।

৪৭ বছর বয়সী এক রোগীর জরুরিভিত্তিতে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করতে হতো। আর কোনো বিকল্প উপায় না থাকায় নতুন হৃৎপিণ্ড পাওয়ার আগ পর্যন্ত চিকিৎসকেরা তাকে সদ্য আবিষ্কৃত এবং তখনো গবেষণার পর্যায়ে থাকা কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড দিয়ে ৬৪ ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখেন।

কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডের এ সাফল্যকে বিশাল অর্জন হিসেবে ধরেন সবাই। কিন্তু সে আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ৩২ ঘণ্টা পর ওই রোগী সেপসিসে (রক্তদূষণ/পচনশীল ক্ষত) মারা যান। 

শুধু তা-ই নয়, ওই কৃত্রিম হৃৎযন্ত্র রোগীর রক্ত ও কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। সংকোচন-প্রসারণ ব্যাগের গায়ে রক্ত জমাট বেঁধে থাকতেও দেখেন চিকিৎসকেরা।

কোনো চিকিৎসাযন্ত্রের তার যদি রোগীর শরীরে স্থায়ীভাবে প্রবেশ করানোর প্রয়োজন পড়ে, সেক্ষেত্রে সংক্রমণ ও সেপসিস একটি নিরন্তর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়ায়। রক্ত সংবহনকারী যন্ত্র রক্তের উপাদানকে বদলে দেয়, এসব যন্ত্রের পৃষ্ঠতল রক্ত জমাট বাঁধার কারণ হয়। ফলে রোগীর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও রক্তের গঠন ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটে।

কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডের পরবর্তী সংস্করণ 'জার্ভিক হার্ট' পাঁচজন রোগীর শরীরে স্থাপন করা হয়। এদের মধ্যে একজন ৬২০ দিন বেঁচে ছিলেন। কিন্তু দুজন রোগী মারাত্মক স্ট্রোক করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সবাই হয় সেপসিস নয়তো রক্তের সমস্যায় মারা যান।

হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের শুরুটাও ভালো যায়নি। সার্জন বার্নার্ডের প্রথম রোগী প্রতিস্থাপনের ১৮ দিন পর মারা যান। যুক্তরাজ্যের প্রথম রোগীর হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল লন্ডনের ন্যাশনাল হার্ট হসপিটালে। ওই রোগীও কেবল ৪৫ দিন বেঁচেছিলেন।
 
তবে এক্ষেত্রে সমস্যা যান্ত্রিক বা নতুন হৃৎপিণ্ডের ছিল না, বরং গ্রহীতা ও দাতার হৃৎপিণ্ডের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার মিল না থাকাতেই রোগীদের মৃত্যু হয়েছিল। পরে ১৯৮০'র দশকে ইমিউন ব্যবস্থার এ সমস্যা সমাধানে ওষুধ আবিষ্কৃত হওয়ার পরে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনে সাফল্যের হার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়।

কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড আবিষ্কারের এ যাত্রায় কিছু সাফল্যের দেখাও মিলেছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড ব্যবহারকারী রোগীদের ৮০ শতাংশ এক বছরের বেশি এবং কিছু রোগী ছয় মাসের বেশি বেঁচে থাকছেন। আর সবচেয়ে বেশি বেঁচে থাকা রোগী ১,৩৭৩ দিন (তিন বছর সাত মাসের বেশি) বেঁচে ছিলেন। কিন্তু এসব রোগীদের ক্ষেত্রে সংক্রমণজনিত জটিলতা একটি সাধারণ বিষয় ছিল।

হৃৎপিণ্ড দাতা পাওয়ার আগ পর্যন্ত রোগীকে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার এ লক্ষ্যে আবারও পরিবর্তন আসে। দুর্বল হৃৎপিণ্ডকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপন করার বদলে কৃত্রিমভাবে রোগীর শরীরে রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করার চেষ্টা শুরু করেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা।

ভেন্ট্রিকুলার অ্যাসিস্ট ডিভাইস বা ভিএডি নামক এ যন্ত্র আক্রান্ত হৃৎপিণ্ড থেকে সম্পূর্ণ নতুন পথে বাইরে এনে রোগীর মহাধমনীতে উচ্চচাপে প্রবেশ করানোর কাজ করে। এ পদ্ধতিতে হৃৎপিণ্ডের ডান ও বাম অংশের রক্ত সঞ্চালনের সমস্যাও সমাধান করতে পারলেন বিজ্ঞানীরা।

হৃৎপিণ্ডের বাম নিলয়ে সঞ্চালিত রক্তের পরিমাণ ডান নিলয়ের প্রায় সমপরিমাণ হতে হয়। এর অন্যথা হলে শরীরের ভুল স্থানে অপ্রয়োজনীয় রক্ত চলে যেতে পারে। আমাদের হৃৎপিণ্ড তৈরিই হয়েছে এমনভাবে যাতে এ ভুল না হয়। কিন্তু কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডের ক্ষেত্রে এ সমতাবিধান করতে বিস্তর সমস্যার মুখোমুখি পড়ছিলেন প্রকৌশলীরা।

কিন্তু ভিএডি'র ক্ষেত্রে এ সমস্যার সমাধান পাওয়া গেল। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ডান বা (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে) বাম নিলয়কে স্বাধীনভাবে সমর্থন করা সম্ভব হলো।

বাম ভিএডি বা এলভিএডি হার্ট ফেইলিওরের শেষ পর্যায়ে থাকা রোগীদের জন্য বিপ্লব নিয়ে এল। এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে ১৫,০০০-এর বেশি এলভিএডি ব্যবহার করা হয়েছে। এ যন্ত্র আবিষ্কার ও ব্যবহারের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নতুন প্রতিস্থাপনযোগ্য হৃৎপিণ্ড পাওয়ার আগ পর্যন্ত রোগীর হৃৎপিণ্ড কৃত্রিমভাবে চালিয়ে রাখা।

কিন্তু দাতা হৃৎপিণ্ডের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ার কারণে এখন রোগীরা বছরের পর বছর এলভিএডি ব্যবহার করে বেঁচে আছেন। এ যন্ত্র ব্যবহার করে ১৩ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার নজির আছে। প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এলভিএডির দক্ষতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপনযোগ্য স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরির এ যাত্রা এখনো অব্যাহত আছে। সহজে বহনযোগ্য করার জন্য কমপ্রেসরগুলোকে মিনিয়েচার আকার দিতে পেরেছেন গবেষকেরা, কিন্তু শরীরে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপন করার কাজে তারা এখনো কোনো সমাধান খুঁজে পাননি। তবে আপাতত ভিএডি ব্যবস্থা রোগীদের জন্য একটি উপায় হতে পারে।

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর