অর্থ ও বাণিজ্য ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১১:১৫

অবশেষে বাতিল হচ্ছে সিটিসেলের লাইসেন্স

আমাদের কাগজ রিপোর্ট: বকেয়া পাওনা, অদূরদর্শী ব্যবসা ইস্যুতে অবশেষে বাতিল হচ্ছে দেশের প্রথম মোবাইল ফোন অপারেটর সিটিসেলের লাইসেন্স। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়েছে বিটিআরসি।

সিটিসেলের লাইসেন্স বাতিলের বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, সিটিসেলের লাইসেন্স থাকার কোনো যুক্তি নেই। তারা দীর্ঘদিন ধরে অপারেটর হিসেবে গ্রাহককে কোনো সেবা দিচ্ছে না। তারা যে প্রযুক্তিতে মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবা দিত সে প্রযুক্তিও বহু পুরোনো হয়ে গেছে, মূলত এখন আর চলে না। এ ছাড়া সিটিসেল কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে বকেয়াও পরিশোধ করছে না। এর লাইসেন্স না রাখাই যুক্তিযুক্ত।

যেভাবে লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত

তথ্যানুসসন্ধানে দেখা যায়, ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে সিটিসেলের অনুকূলে বরাদ্দকৃত ও নবায়নকৃত সমুদয় বেতারতরঙ্গ বাতিল করে বিটিআরসি। তবে বেতারতরঙ্গ এবং রেডিও কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট লাইসেন্স বাতিল করা হলেও সিটিসেল পরিচালনা করা কোম্পানি প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেডের (পিবিটিএল) জন্য বরাদ্দ করা সেলুলার মোবাইল অপারেটর লাইসেন্স এখনও রয়ে গেছে। ফলে লাইসেন্সের বিপরীতে প্রয়োজনীয় ফি ও অন্যান্য পাওনা নায্যভাবেই প্রাপ্য হয় বিটিআরসি।

বিটিআরসি সূত্র জানায়, বর্তমানে সিটিসেলের কাছে বিটিআরসির মোট পাওনা ২১৮ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার ৬৫৯ টাকা। বারবার চিঠি দেওয়ার পরও বকেয়ার এ টাকা সময়মতো পরিশোধ না করায় ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর সিটিসেলকে কেন লাইসেন্স বাতিল করা হবে না তার কারণ জানতে চেয়ে ৩০ দিনের মধ্যে জবাবের সময় বেঁধে দিয়ে নোটিস দেয় বিটিআরসি।

নোটিসের জবাবে সিটিসেল কর্তৃপক্ষ লিখে, বিটিআরসির ভূমিকা হওয়া উচিত সিটিসেলের অভিভাবক এবং সুরক্ষাকারী হিসেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে বিটিআরসি কোনো মহলের স্বার্থরক্ষার অংশ হিসেবে সিটিসেলকে সেই সুরক্ষা দিচ্ছে না।

সিটিসেল জবাবপত্রে আরও লিখেছে, সিটিসেল কর্তৃপক্ষ নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজে বের করার মাধ্যমে পুনরায় সিটিসেলের মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতর বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় সিটিসেলকে আরও সময় দেওয়া উচিত বলে চিঠিতে মন্তব্য করা হয়।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, সিটিসিলের ওই জবাব পাওয়ার পর বিটিআরসি এ বিষয়ে কমিশনের আইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লেক্স কাউন্সিলের কাছ থেকে আইনগত মতামত নেয়। লেক্স কাউন্সিল তাদের মতামতে উল্লেখ করে, ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী বিটিআরসি একদিকে যেমন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ, অন্যদিকে আইনগত কর্তৃত্ব প্রয়োগের জন্যও ক্ষমতাপ্রাপ্ত।

২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনের ৪৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া পরিশোধ না করার জন্য লাইসেন্স বাতিলের মতো ক্ষমতা প্রয়োগে বিটিআরসির সামনে আইনগত কোনো বাধা নেই। লেক্স কাউন্সিলের মতামত পাওয়ার পর বিটিআরসি ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনের ৪৬(৩)(খে) অনুযায়ী প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেডের অনুকূলে থাকা সেলুলার মোবাইল অপারেটর লাইসেন্স বাতিলের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

অদূরদর্শিতার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে সিটিসেল

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেলিযোগাযোগ খাতের উচ্চ পদে দীর্ঘদিন কাজ করা একজন বিশেষজ্ঞ জানান, সিটিসেল যে সময়ে সিডিএমএ (কোড ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাকসেস) প্রযুক্তি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল, সে সময়ে এই প্রযুক্তিই ছিল মোবাইল টেলিযোগাযোগ ব্যবসার জন্য অত্যন্ত উপযোগী। যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক উন্নত দেশে সিডিএমএ প্রযুক্তি ব্যবহার করা দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহক সংখ্যায় শীর্ষে অবস্থান করেছে।

কিন্তু সিটিসেল প্রকৃতপক্ষে শুরু থেকে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসার কোনো পরিকল্পনা করেনি। বরং স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশি লাভের সূত্র প্রয়োগ করতে গিয়ে একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত অদূরদর্শী ব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপনার খেসারত হিসেবে সিটিসেলকে অপমৃত্যু বরণ করতে হয়েছে ২০১৬ সালেই। এখন লাইসেন্স বাতিল একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

১৯৮৯ সালে সিটিসেলের যাত্রা শুরু। তখন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (বিটিএল) নামে একটি কোম্পানি দেশে প্রথমবারের মতো সেলুলার ফোন বা মোবাইল ফোন সেবা দেওয়ার লাইসেন্স পায়। সে সময় বিটিআরসি ছিল না, লাইসেন্স দিত বিটিটিবি (আজকের বিটিসিএল)। দেড় পাতার লাইসেন্সে বিটিএলকে একই সঙ্গে মোবাইল এবং ল্যান্ড ফোন সেবা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। খুব কম মূল্যেই বেতারতরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া হয়।

১৯৯০ সালে বিটিএলের সঙ্গে বিনিয়োগ নিয়ে যুক্ত হয় হংকংয়ের হাটসন টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড। যেখানে অংশীদার হয় ফারইস্ট টেলিকম নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বিটিএল থেকে নাম বদলে হয় হাটসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড-এইচবিটিএল।

১৯৯৩ সালে তৎকালীন বিএনপি নেতা এম মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মটরস, ফারইস্ট টেলিকম এবং সিঙ্গাপুরের সিংটেল মিলে এইচবিটিএলের শেয়ার কিনে নেয়। এখানে প্যাসিফিক মটরসের শেয়ার ছিল ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ফারইস্ট টেলিকমের ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং সিংটেলের শেয়ার ছিল ৪৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ সময় এইচবিটিএলের নাম বদলে হয় দ্য প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড।

আর মোবাইল ফোন অপারেটরের ব্র্যান্ড নাম হয় সিটিসেল। প্রথম পর্যায়ে সিটিসেলের কলের দাম ছিল প্রতি মিনিট ১৪ টাকা। গ্রাহককে ইনকামিংয়ের জন্যও টাকা গুনতে হতো। হ্যান্ডসেটের দাম ছিল ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা

সিটিসেল শুরুতেই সে সময়ে বিশ্বের অপেক্ষাকৃত উন্নত এবং কম খরচের সিডিএমএ (কোড ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাকসেস) প্রযুক্তিতে সেবা দেওয়া শুরু করে। ১৯৯৩ সালে যাত্রা শুরুর সময় সিটিসেল ছিল দেশের প্রথম এবং দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় টেলিকম অপারেটর।

দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৮৯ সালে প্রথম মোবাইল অপারেটর হিসেবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করেছিল শ্রীলঙ্কার সেলটেল। বর্তমানে এটি শ্রীলঙ্কায় ২৬ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দেয় সিটিসেল কর্তৃপক্ষ।

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর