জাতীয় ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১১:৪৯

২০১৩-এর গণজাগরণ : শাহবাগের ‘রাজনীতি’ জল গড়িয়েছে কতদূর?

আমাদের কাগজ রিপোর্ট: ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি বিকেল। শাহবাগ মোড়ে ফেস্টুন হাতে দাড়িয়েছিল কয়েক তরুণ।  চিহ্নিত যু্দ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারে ফাঁসির রায় না হওয়ায় স্তব্ধ পুরো দেশ। একে একে রাজধানীর শাহবাগে জড়ো হওয়া তরুণেরা বিস্ময়ে প্রশ্ন তোলেন রাষ্ট্রের কাছেচিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারে চূড়ান্ত শাস্তি কেন হবে না? মুহূর্তে উত্তাল পুরো দেশ, এমনকি বিদেশেও ওঠে একই ঝড়। সেই ফেব্রুয়ারিতে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার দশ বছর পূর্তি আজ।

এরই মধ্যে প্রথমসারির যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। তৃণমূলের যারা জড়িত ছিল সেই অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া এখনও চলছে। এরইমধ্যে দশটি বছর পার। কী মূল্যায়ন সংগঠকদের? এতো বড় জাগরণের পরে কী-বা পরিবর্তন এলো রাজনীতিতে?

সংগঠকরা বলছেন, যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে ১০ বছর আগে গণজাগরণ তৈরি হয়েছিল, তা সফলভাবে করা গেছে। আর মৌলবাদীরা যে বারবার একটি প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র গঠনে তৎপর হয়েছে সেটা শাহবাগের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল।

শাহবাগে তৈরি হওয়া সেই আন্দোলন নিয়ে পরবর্তীতে কয়েকটি পক্ষ-বিপক্ষ লক্ষ্য করা গেছে। নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের ভাবনাতেও নানারকমের পরিবর্তন এসেছে। একদল মনে করেন, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যা ছিল, হাসিল হয়েছে, ঘরে ফিরে গেছি। আরেক দল মনে করেন, যেকোনও অন্যায় রুখে দিতে শাহবাগে এখনও ছোট পরিসরে যে জমায়েত হয় তা গণজাগরণেরই ধারাবাহিক রূপ। কেউ বলছেন, গণজাগরণের আগে ছিল জেদী তারুণ্য, আর পরে এলো হতাশ সুবিধাবাদী তারুণ্য। প্রশ্ন হলো, এই হতাশার কারণ তাহলে কী?

সংগঠকদের অন্যতম আরিফ জেবতিক মনে করেন, ১৯৯৩ সাল থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার সফল সমাপনী ঘটেছে। শাহবাগ আন্দোলনের দশ বছর পূর্তিতে মূল্যায়ন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলনের শুরু হয়েছিল সেটি পূর্ণ হয়েছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্তোষ প্রকাশ করি। আমরা গোলাম আযমের ফাঁসি কার্যকর করতে পারিনি। সাঈদীর লঘু শাস্তি হয়েছে। সেসব নিয়ে না-পাওয়ার জায়গা আছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হবে বলে যে স্বপ্ন বুকে লালন করেছিলাম সেটি আমরা পেয়েছি এবং এই আন্দোলন আমার ব্যক্তিজীবনে মাইলফলক বলে আমি বিশ্বাস করি।

তিনি মনে করেন, শাহবাগকেন্দ্রিক মুভমেন্টের পরে কেবল তরুণদের ভেতরে না, বাংলাদেশের রাজনীতিতেও নতুন পরিবর্তন এসেছে। একদিকে লোকজন মৌলবাদীদের নিয়ে সচেতন হয়েছে। আরেকদিকে বাংলাদেশ গড়তে শাহবাগ মঞ্চের যে স্পিরিট সেটা যেন বাধাগ্রস্ত হয় মৌলবাদীরা সেই চেষ্টায় রয়েছে। তারা তাদের যেকোনও রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায়ভার এখনও শাহবাগের ওপর ফেলতে চায়। আমি বিশ্বাস করি, যদি শাহবাগ না হতো তাহলে বাংলাদেশ আফগানিস্তানে পরিণত হতে পারতো। আমরা বাধা তৈরি করতে পেরেছি। সেটা চূড়ান্ত বাধা দেওয়া হয়েছে কিনা তা সময় বলে দেবে। কিন্তু যে দ্রততার সঙ্গে তারা এগুচ্ছিল সেটা প্রলম্বিত করা গেছে। সেকারণেই তাদের সব ক্ষোভ-দুঃখের জন্য তারা শাহবাগকে দায়ী করে। তারা জানে তাদের কী ক্ষতি হয়েছে।

গণজাগরণের সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন খান আসাদুজ্জামান মাসুম। ক্ষমতাসীন সরকার শাহবাগের স্পিরিট ধরে রাখতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্রে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হওয়া উচিত- এই প্রত্যাশা নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসীন তারা সেই স্পিরিট ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন থেকে তাদের মনোযোগ সরে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। যেটা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার পরিপন্থি।

তিনি বলেন, ৭২ এর সংবিধানের যে ভিত্তি সেই জায়গা থেকে সরকার নিজেদের গুটিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। সেটা গণজাগরণ চেতনার পরিপন্থি। ফলে সাধারণ মানুষ যে চেতনা নিয়ে ওখানে গিয়েছিল, তারা প্রতারিত বোধ করেছে। অনেকাংশে হতাশাগ্রস্ত হয়েছে।

শাহবাগের সেই আন্দোলনের স্পিরিট ধরে রাখতে সংগঠকদের কোনও পরিকল্পনা আছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি একটা চেতনার নাম। এটা হঠাৎ গড়ে ওঠা আন্দোলন না। দীর্ঘসময় ধরে মানুষের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিষ্ঠা করার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছিল। সেটি বাস্তবায়ন মানে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা তৈরি। এই মঞ্চকে বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের মতো করে ব্যবহার করেছে। আমরা চাই না কারোর জন্য এরকম মঞ্চ ব্যবহৃত হোক। পরবর্তীতেনিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে শাহবাগনানা প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। আমি মনে করি এটা গণজাগরণ মঞ্চের ধারাবাহিকতা। এটা যখন বড় হবে তখন সমাজে, রাষ্ট্রে পরিবর্তন আসবে।

শাহবাগের আন্দোলনের পরে নানা ধরনের হুমকি কাঁধে নিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল ব্লগারদের একটা বড় অংশকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে দীর্ঘবছর আন্দোলনে সক্রিয় ব্লগার অমি রহমান পিয়াল তাদের একজন। গণজাগরণের আগের পরের সময়ে তরুণদের মধ্যে কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করেন কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, গণজাগরণের আগে ছিল জেদী তারুণ্য, পরে এলো হতাশ এবং সুবিধাবাদী তারুণ্য। গণজাগরণের সময় দুইটা স্রোত ছিল। একদল ২০০৮ নির্বাচনের সময়ই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতিকে ম্যান্ডেট করতে বাধ্য করেছিল। তারা সেটা বাস্তবায়নের অপেক্ষা করেছে। কাদের মোল্লার রায়ে ক্ষুব্ধ হয়েছে। ২০১৩-তে রাস্তায় নেমে অধিকার আদায় করে ঘরে ফিরে গেছে। আরেকদল ছিল ম্যানিপুলেটিভ শ্রেণি, যারা এদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ এবং ক্যাশ করতে চেয়েছে। ছবির হাটে চা খাওয়া আর গসিপ ছড়ানো বাদে এরা কিছু করেনি। মূল স্রোত চুপচাপ তাদের কাজ সেরে ফেলেছে। তো আজ আমরা অনেক বিপ্লবী দেখি, আন্দোলনের নেতৃত্বের দাবিদার দেখি, আর মুখ লুকিয়ে হাসি।

এখনও কিছু হলে মানুষ শাহবাগে দাঁড়ায়, সেটা গণজাগরণের স্পিরিটের ধারাবাহিকতা কিনা- প্রশ্নে তিনি বলেন, এখনও কিছু হলেই মানুষ শাহবাগে যায়। চটপটি, পানি, চা ওয়ালাসহ জনা দশেক মানুষ হয়। আগেই বলেছি তারুণ্য এখন হতাশ এবং সুবিধাবাদী। তারা শাহবাগের মতো কিছু চাইলেও সুবিধাবাদী নেতৃত্ব তাদের নগদে বিক্রি করে ক্যাশ করে নেয়। এর প্রভাব রাজনীতিতেও স্পষ্ট, তরুণরা আগ্রহ হারিয়ে হতাশ। যারা আছে তারা সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী। তারুণ্যের পালস তারা বোঝে না।

এই মঞ্চের মধ্য দিয়ে নেতৃত্বে পরিচিত মুখ গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারে সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।

অনেক মতবিরোধ সত্ত্বেও লক্ষ্য অর্জনে সম্মিলিতভাবে কাজ করার জায়গা ছিল উল্লেখ করে গণজাগরণ নিয়ে কর্মরত গবেষক শিক্ষক শরৎ চৌধুরী বলেন, শাহবাগে কেবল প্রভাবশালী বয়ান ছিল তা নয়, এর ভেতরে নানা রকমের বয়ান ছিল। চেনামুখ যারা তারা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। আবার হেফাজত জায়গা করে নিচ্ছিল যখন, তখন তাদেরক্ষমতাহারাতেও দেখা গেছে। পরবর্তীতে ব্লগার হত্যা, গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে একসময়েরহিরোদেরআমরা আবার একটা সময় পরেভিলেনহতে দেখেছি। শাহবাগে কেউ বলেছেএরা সরকারের পক্ষে কাজ করছে’, কেউ বলেছেএরা কেবল মোমবাতি জ্বালায় এবং ইমরান এইচ সরকার অন্যদের সহায়তায় সেটা বেশ ভালোভাবে সামলেছেন।

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর