অর্থ ও বাণিজ্য ২৭ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৮:০৬

জ্বালানি তেলের দাম কমবে না: বিপিসি

আমাদের কাগজ রিপোর্ট: বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৮২ থেকে ৮৪ ডলারের মধ্যে রয়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর আলোচনা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। অথচ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, তারা লোকসানে রয়েছে।

গত বছর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অপরিশোধিত জ্বালানির দাম ব্যারেল প্রতি ৮৫ ডলারের ওপরে উঠলে দেশে তেল বিক্রি করে বিপিসি লোকসানে পড়ে। সেই যুক্তিতে গত আগস্ট সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়।

জ্বালানি তেলের দাম কমানোর আলোচনার মধ্যে বিপিসির চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন, পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেল প্রতি ১০৫ ডলার রয়েছে। এতে লিটারে থেকে টাকা লোকসান হচ্ছে। ফলে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর বিষয়ে বিপিসি কিছু ভাবছে না।

মঙ্গলবার ঢাকায় কারওয়ান বাজারে বিপিসির কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান বি এম আজাদ বলেন, পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে ১০৩ ডলার থাকলে আমরা ব্রেক ইভেনে থাকি। কিন্তু এর বেশি হলেই আমাদের লোকসান হয়।

সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, বিপিসির এখনো লোকসান প্রতি মাসে ৪৩ কোটি টাকার মতো। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তাদের গড়ে লোকসান হয়েছে ২৩৩ কোটি টাকা। এরমধ্যে ডিজেল ছাড়া অন্য তেলে লাভ হওয়ায় এখন তাদের মোট লোকসান এসে দাঁড়িয়েছে ৪৩ কোটিতে।

গত আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে ভোক্তা পর্যায়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ১১৪ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে জ্বালানি খনিজসম্পদ বিভাগ।

এর আগে ২০২১ সালের নভেম্বর ডিজেল কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয়। তখন এই দুই জ্বালানির দাম লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়।

২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। সেই সময় ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা, কেরোসিনের দাম ৬৫ টাকা, অকটেনের দাম ৮৯ টাকা পেট্রোলের দাম ৮৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

রাশিায়-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ ডলারে উঠেছিল। গত সপ্তাহে এই দাম গড়ে ৮০ ডলারের নিচে নেমে আসে। অবশ্য মঙ্গলবার ছিল ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৮৪.২৫ ডলার।

সরকারের জ্বালানি বিভাগ থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সময় বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশের বাজারে দাম কমবে। জ্বালানি বিভাগ তেলের দাম কমানোর বিষয় জানতে চেয়েছিল। এই বিষয়ে বিপিসি চিঠি দিয়ে জ্বালানি বিভাগকে জানিয়েছে, এখনো বিপিসি তেল বিক্রি করে লোকসান করছে সে কারণে দাম কমানো যাবে না।

বিপিসির লাভের টাকা গেলো কোথায়?

বিপিসি ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত সাত অর্থবছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে মুনাফা করেছে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ বিপিসি বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে রেখেছে। যে হারে মুনাফা করেছে বিপিসি সেই হারে তেলের দাম কমায়নি প্রতিষ্ঠানটি। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে গত আগস্ট নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়।

পরে সমালোচনার মুখে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটার প্রতি টাকা কমানো হয়। বর্তমানে লিটার প্রতি ভোক্তা পর্যায়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ১০৯ টাকা, কেরোসিন ১০৯ টাকা, অকটেন ১৩০ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ১২৫ টাকা

২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন ধরনের ৬৩ লাখ মেট্রিক টন তেল বিক্রি করেছে বিপিসি। এর মধ্যে প্রায় ৭৩ শতাংশই ডিজেল। অকটেন শতাংশ এবং পেট্রোল শতাংশের মতো।

জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত উপজাত কনডেনসেট থেকে পেট্রোল অকটেন তৈরি হয়। যেহেতু দেশের পেট্রোল অকেটেনের মান ভাল না সে কারণে বিদেশ থেকে কিছু পরিমাণ অকটেন (বুস্টার হিসেবে) পেট্রোল কিনে আনা হয়, সেই পেট্রোল অকটেনের সঙ্গে দেশীয় তেল মিশিয়ে বিক্রি করা হয়।

বিপিসির দাবি, প্রতি মাসে অকটেন পেট্রোল বিক্রি করে লাভ হয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা। আর জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি এই লাভ আরও অনেক বেশি। বিপিসি কখনো তাদের আয়-ব্যায়ের প্রকৃত তথ্য মন্ত্রণালয়কে দেয় না। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, দেশের খনি থেকে উৎপাদিত কনডেনসেট থেকে উৎপাদিত পেট্রোল অকেটেনের দাম ৬০ টাকার নিচে, আর বাজারে বিক্রি হচ্ছে অকটেন ১৩০ টাকা লিটার পেট্রোল ১২৫ টাকা লিটার। আর বিপিসি দাবি করছে তারা অকটেন বিক্রি করে মাত্র ২৫ টাকা লাভ করছে।

এই বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম দৈনিক বাংলাকে বলেন, বিপিসি মুনাফা করেছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এখন তারা লোকসানের নতুন হিসাব বানিয়েছে। এইসব হিসাবে গরমিল আছে। বিপিসিকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে অডিট করা দরকার। তাদের বলা লাভ লোকসানে প্রকৃত চিত্র থাকে না।

শামসুল আলম আরও বলেন, অযৌক্তিকভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে মূল্যাস্ফীতি বেড়েছে। মানুষের আর্থিক অবস্থা রাতারাতি খারাপ হয়েছে। বিপিসি যারা চালায় তাদের মাথায় এসব থাকে না। জনগনের প্রতিষ্ঠানকে তারা নিজের সম্পত্তি হিসেবে দেখে। এটা দুঃখজনক।