অর্থ ও বাণিজ্য ৩ নভেম্বর, ২০২২ ০৪:৩৮

বিটকয়েন নিয়ে যে দুশ্চিন্তায় বাংলাদেশ ব্যাংক

তানজিলুর রহমান: বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের পরও থামছে না ভার্চুয়াল মুদ্রায় হচ্ছে সন্দেহজনক লেনদেন। মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে হচ্ছে এসব অপরাধ। যুবকরাই এসব পথে পা বাড়াচ্ছেন বেশি। ভার্চুয়াল মুদ্রা অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপ প্রতিবেদন (এসএআর) বাড়ছে বলে এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশে এসব মুদ্রায় লেনদেন বেআইনি হওয়ার পরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশের ভেতর থেকে বিদেশে ধরনের মুদ্রায় লেনদেন হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে এসেছে। ফলে চলতি বছর সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়ে সতর্ক করে সার্কুলার জারি করে।

সার্কুলারে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়ার পরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশের ভেতর থেকে বিদেশে ধরনের মুদ্রায় লেনদেন হচ্ছে। ধরনের লেনদেন ক্রমেই বেড়েই চলেছে। প্রতারিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এতে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে। রপ্তানি আয়ের একটি অংশ দেশে না এনে ডিজিটাল মুদ্রায় রূপান্তর করে তা দিয়ে বিভিন্ন দেনা শোধ করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন করে সার্কুলার জারি করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সতর্কতা এবং নানান নেতিবাচক উদাহরণ সামনে এলেও বাংলাদেশে বিটকয়েনের ব্যবহার থেমে নেই। তবে ঠিক কত মানুষ এই লেনদেনে রয়েছেন তার সঠিক কোনো তথ্য সংস্থার বা প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই।

জুয়া, হুন্ডি চোরাচালান সাইবার চাঁদাবাজিতে ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রা। মাঝেমধ্যেই অভিযান চালিয়ে অবৈধ এই লেনদেনে অংশ নেয়া চক্রকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। বলা হচ্ছে, যারা তরুণ, তারা এই ধরনের কাজে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন। বিভিন্ন দেশে এই লেনদেন বৈধ থাকায় অনেকেই উৎসাহিত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে গত বছরের ভার্চুয়াল মুদ্রা অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয়, ধরনের লেনদেন নিয়ে বিএফআইইউর কাছে আগের চেয়ে বেশি তথ্য দিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। চলতি জুন শেষে এসটিআর এসএআর সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে ১০৭টি। এর মধ্যে ২২টি সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন ৮৫টি সন্দেহজনক কার্যকলাপ প্রতিবেদন।

এই প্রতিবেদনের ৫৫ শতাংশ দুটি মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার, ২১ শতাংশ দুটি ব্যাংক এবং বাকি ২৪ শতাংশ অন্যান্য সাতটি ব্যাংক থেকে পাওয়া গেছে। তবে প্রতিবেদনে কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

বিএফআইইউ বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথম ভার্চুয়াল মুদ্রা অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বয়স, নারী-পুরুষ, পেশা অনুযায়ী চিত্র পাওয়া গেছে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ কয়েক ধরনের ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রা হচ্ছে বিটকয়েন। ছাড়া আছে লাইটকয়েন, এথেরিয়াম, রিপলের মতো কিছু ভার্চুয়াল মুদ্রাও। এসব মুদ্রায় বিশ্বব্যাপী লেনদেন বাড়ছে।

বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেল, এমএফএস ছাড়াও বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে অর্থ পাচারের তথ্য খতিয়ে দেখতে কাজ করা হচ্ছে। কোথাও কোনো অসংগতি পেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে জানানো হয়।

বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, মানুষ এখনও এটা সম্বন্ধে ভালোভাবে বোঝে না। আর বিশ্বব্যাপী এটা কোনো বৈধ অনুমোদিত মুদ্রা না। এটার মাধ্যমে টাকা পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে এটা মানি লন্ডারিংয়ে সাহায্য করবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে লেনদেনে বেশি

২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন ব্যাংক, মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিএফআইইউতে ১১টি প্রতিবেদন জমা দেয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেটা বেড়ে হয় ২৯টি। ২০১৯-২০ বছরে তা অস্বাভাবিকভাবে কমে তিনটিতে দাঁড়ায়। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে সেটা বেড়ে ১৫টি এবং সবশেষ ২০২১-২২ ৪৯টিতে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এসটিআর এসএআর-এর ৩৬ শতাংশ লেনদেন হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওয়েবসাইট ব্যবহার করে। এখানে একটা অ্যাকাউন্ট নম্বর দেয়া থাকে, যেখানে লেনদেন করতে হয়। আর ১০ শতাংশ অন্যভাবে করা হয়।

যুবকরা আকৃষ্ট বেশি

ভার্চুয়াল মুদ্রা এবং অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিং সম্পর্কিত এসটিআর বা এসএআর- ৯২ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা হয়েছে। একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক রিপোর্টও আছে। তাদের মধ্যে পাঁচ ভাগের চার ভাগ পুরুষ এবং অবশিষ্ট নারী। শতকরা হার পুরুষ ৮০ শতাংশ নারী ২০ শতাংশ।

বয়স বিবেচনায় দেখা গেছে, বেশির ভাগই যুবক (৩৯ শতাংশ), যাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ২৮ শতাংশের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ২১ শতাংশ এবং ৫০ উর্ধ্ব ১২ শতাংশ।

পেশাগতভাবে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ব্যক্তি ব্যবসায়ী (৩৮ শতাংশ), চাকরিজীবী ২১ শতাংশ, ছাত্র ১৫ শতাংশ এবং আইটি পেশাদার বা ফ্রিল্যান্সার শতাংশ।

১৭টি ঘটনা শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী

গত বছরে অবৈধভাবে ভার্চুয়াল মুদ্রা বা অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিং-সংক্রান্ত ১৭টি ঘটনা শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এর মধ্যে ১৪টিতে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৫৩ জন আটক হয়েছে।

কৃষক, গৃহিণী, ছাত্র, ফ্রিল্যন্সার আইটি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়ে এই ভার্চুয়াল মুদ্রার অবৈধ ব্যবসা করা হয়েছে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে।

বিএফআইইউ পরামর্শ দিয়েছে, ব্যাংকের মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে হওয়া লেনদেন নিবিড় তদারকি করতে হবে।

অনুসন্ধানে সংস্থাটি দেখেছে, ভার্চুয়াল কারেন্সির ব্যবসায় লেনদেন হওয়া অর্থের ৭৪ শতাংশ হয়েছে ইন্টারনেট ব্যাংকিং মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে।

 

 

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর