অপরাধ ও দুর্নীতি ১৯ অক্টোবর, ২০২২ ০১:১৭

কোন জাদুর পরশে শূন্য থেকে ৫০ কোটির মালিক জিয়াউর

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাবা ঘানিতে ভেঙে সরিষার তেল বিক্রি করতেন। তেল বিক্রির টাকায় চলতো পুরো পরিবার। দুই ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে কেউই বড়লোক নন। দারিদ্রতায় কেটেছিলো তাদের জীবন। দিন এনে দিনে খাওয়া পরিবারটির প্রেক্ষাপট চোখের পলকে বদলে যায়। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) গাড়িচালকের পদে চাকরি তাদের জীবনে আসে জাদুর পরশ হয়ে।

জাদুর পরশ পাওয়া ব্যক্তিটি হলেন জিয়াউর রহমান। প্রতিষ্ঠানটিতে ১২ হাজার টাকা বেতনের একটি সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। ১৭ বছরে প্রায় শূন্য থেকে ৫০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের গল্প বদলে যায় আরব্য রজনীর রূপকথার মত।

মো. জিয়াউর রহমানের এখন ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে আছে সাততলা বাড়ি আগামসি লেনে দামি ফ্ল্যাট রয়েছে। আশুলিয়ায় বানাচ্ছেন আরেকটি বাড়ি। যশোর শহরে সদ্য নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল ছয়তলা বাড়ি। আত্মীয়স্বজনের নামে রয়েছে ব্যাংক ব্যালান্স এবং কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী জিয়াউর রহমান এনটিআরসিএর শিক্ষক নিবন্ধন বাণিজ্যের প্রধান হোতা। লাখ টাকার বিনিময়ে শিক্ষকদের নিবন্ধন সনদ পাইয়ে দেন। লাখ টাকার বিনিময়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরির সুপারিশ পাইয়ে দেওয়ার জন্য তদবির সুপারিশ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন এনটিআরসিএর সিস্টেম অ্যানালিস্ট ওয়াসি উদ্দিন রাসেল। সরকারি চাকরি ছেড়ে ২০২০ সালে পরিবারসহ কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন রাসেল। তিনি শিক্ষক-নিবন্ধন চাকরির সুপারিশপত্র প্রস্তুত করতেন। ড্রাইভার জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রার্থীদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে শিক্ষক-নিবন্ধন চাকরির সুপারিশের ব্যবস্থা করে দিতেন তিনি। সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে এনটিআরসিএ গঠিত হওয়ার পরই ড্রাইভার হিসেবে চাকরি নেন মো. জিয়াউর রহমান। ৩৩০০-৬৯৪০ টাকা বেতন স্কেলে তিনি তখন সাকল্যে ১২ হাজার টাকা বেতন পেতেন। বর্তমানে ১০২০০-২৪৬৮০ টাকা বেতন স্কেলে সাকল্যে ৩৬ হাজার টাকা বেতন পান। প্রতিষ্ঠানে গত ১৭ বছরে ১৮ জন চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের বেশিরভাগেরই গাড়িচালক ছিলেন জিয়াউর রহমান। তবে বর্তমান চেয়ারম্যানের গাড়ি চালানোর দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়নি।

এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান মো. এনামুল কাদের খান মঙ্গলবার বলেন, আমি সাড়ে চার মাস হলো যোগদান করেছি। আমার সময়ে এখনো কোনো পরীক্ষা হয়নি। জিয়াউর রহমান নামে যে ড্রাইভারের কথা বলছেন, তাকে আমি চিনিও না। তবে আজই আমি তার ব্যাপারে খোঁজ নেব।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ২৫২, আমবাগিচা আগানগরে শতাংশ জমির ওপর সাততলা বাড়ি রয়েছে জিয়ার, যার মূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি। পুরান ঢাকার ১১৪ নম্বর আগামসি লেনের তৃতীয় তলায় রয়েছে একটি অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট, যার দাম কোটি টাকা। যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের পশ্চিম পাশে বিমানবন্দর সড়ক লাগোয়া একটি ছয়তলা দৃষ্টিনন্দন বিশাল বাড়ির কাজ শেষ করেছেন জিয়াউর রহমান। সেখানে জায়গার পরিমাণ প্রায় ১২ কাঠা। ওই বাড়ি নিয়ে ওই এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। বাড়িটির দাম প্রায় ১৫ কোটি টাকা। ছাড়া ঢাকার আশুলিয়ায় ১০ কাঠা জায়গায় বিলাসবহুল বাড়ি করছেন তিনি। এর মূল্য কয়েক কোটি টাকা। যশোর শহরের রূপদিয়া এলাকায় তার স্ত্রী, স্ত্রীর বোন তার ভাইয়ের নামে কয়েক বিঘা সম্পত্তি রয়েছে। এসবের মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। আত্মীয়স্বজনের নামে বেনামে তার আরও সম্পত্তি রয়েছে এবং কোটি কোটি টাকা রয়েছে। তার চারটি মাইক্রোবাস রেন্ট--কারে ভাড়া দেওয়া আছে।

জানা যায়, জিয়াউর রহমান ড্রাইভার হলেও নিজে এবং তার পরিবারের সদস্যরা চলাফেরা করেন ব্যক্তিগত গাড়িতে। তার নিজস্ব গাড়ির জন্য ড্রাইভারও রয়েছে। সন্তানকে পড়ান রাজধানীর কাকরাইলের একটি অভিজাত স্কুলে। তার অফিসও কাকরাইলের পাশে ইস্কাটনে। সকালে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে বের হন তিনি। সন্তানকে স্কুলে নামিয়ে কিছুটা দূরে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে অফিসে যান।

জিয়ার কেরানীগঞ্জের বাড়ির দলিলের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। ২০১৪ সালে করা ওই দলিলে তার স্থায়ী ঠিকানায় গ্রাম-চাউলিয়া, ডাকঘর-রূপদিয়া, উপজেলা-কোতোয়ালি, জেলা-যশোর উল্লেখ করা আছে। বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করা আছে ১১৪ আগামসি লেন, বংশাল, ঢাকা।

জানা গেছে, জিয়াউর রহমান সরকারি ছুটির দিনে নিয়মিত বিমানযোগে যশোরে যাওয়া-আসা করেন। সাধারণত সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় ঢাকায় ফেরেন। অঢেল অর্থের মালিক হলেও গ্রামের বাড়ি চাউলিয়ার বাড়িঘরের খুব বেশি পরিবর্তন করেননি তিনি। তবে যশোর শহরে তার বাড়ি আছে বলে গ্রামের লোকজন জানেন। তার চলাফেরা বিপুল বিত্তবৈভবে গ্রামের বাড়ির লোকজন হতবাক। তার এলাকার লোকজন জানেন, তিনি শিক্ষামন্ত্রীর গাড়িচালক। গ্রামে কম যান, তবে যখন যান তার চলাফেরা পোশাক-আশাক বড় কর্মকর্তাদের মতোই থাকে।

সূত্র জানায়, মো. জিয়াউর রহমান মূলত মাউশি অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মচারীর মাধ্যমে শিক্ষক নিবন্ধন চাকরির সুপারিশের প্রার্থী জোগাড় করতেন। ২০০৫ সালে শুরু হওয়া নিবন্ধনে জালিয়াতি করে দেদার সনদ বিক্রি করেছেন। কাজে সহযোগী হিসেবে মাউশির সাবেক কর্মচারী নেতা বর্তমানে অবসরে যাওয়া কর্মচারী বদিউজ্জামান, বর্তমান উচ্চমান সহকারী নজমুল হোসেন কিছুদিন আগে সমাপ্ত হওয়া একটি প্রকল্পের গাড়িচালক মো. নজরুল ইসলামের নাম জোরেশোরে শোনা যায়। নজরুল ইসলাম অনেক প্রার্থী জোগাড় করে দিতেন। একবার তিনি যে কয়জন প্রার্থী দিয়েছিলেন তাদের সবাই শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ না হওয়ায় জিয়াউর রহমান তাদের টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করেন। নিয়ে মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরে ত্রিপক্ষীয় সভা হয়েছিল, যার মাধ্যমে কিছু টাকা ফেরত দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। সিস্টেম অ্যানালিস্ট ওয়াসি উদ্দিন রাসেল কানাডায় চলে যাওয়ার পর তার সনদবাণিজ্যে ভাটা পড়ে।

গাড়িচালক নজরুল ইসলাম বলেন, আমি বড় কোনো টাকা-পয়সা দিইনি। একবার একটা কাজের জন্য অল্প টাকা দিয়েছিলাম। তবে কাজ হয়নি; জিয়াউর রহমান টাকাও ফেরত দেয়নি।

ঢাকার বাড়িতে সরেজমিনে : বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর বাবুবাজার ব্রিজ পার হয়েই বাঁ পাশে সার্বিক বাস কাউন্টার। কাউন্টার ঘেঁষে একটা গলি গেছে। মূল রাস্তা থেকে সার্বিক কাউন্টারের গলি দিয়ে দেড়শ-দুইশ গজ গেলেই জিয়াউর রহমানের বাড়ি। তিনি এলাকায় জিয়া নামে পরিচিত।

গত সোমবার দুপুরে তার বাড়ির এলাকায় গিয়ে জিয়া ভাইয়ের বাড়ি কোনটা বলতেই একজন দেখিয়ে দিলেন। সাততলা বাড়ির প্রতিতলায় চারটি করে ইউনিট। দ্বিতীয় তলায় একটি ইউনিট ভাড়া জেনে ভাড়াটিয়া সেজে বাড়িতে ঢুকে জানা যায়, জিয়া তার পরিবার নিয়ে তিনতলার পুরোটায় থাকেন। আধুনিক সাজসজ্জার পাশাপাশি তিনটি রুমে এসি রয়েছে। নিচতলায় ছোট একটা পার্কিং। কেয়ারটেকার জানান, সেখানে জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত গাড়ি থাকে।

কেয়ারটেকার আবদুল জলিলের সঙ্গে ভাড়াটিয়া বেশে কথা হয় প্রতিবেদকের। মালিকের সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জিয়া সাহেব সচিবালয়ের বড় কর্মকর্তা। তিনি এখন বাসায় নেই। বাড়িভাড়ার ব্যাপারে কথা বললে বাইরে টানানো একটি নম্বর দেখিয়ে দেন। সেই নম্বর জিয়াউর রহমানের স্ত্রীর বলে জানান। এলাকার একজন চা-দোকানির সঙ্গে কথা বললে তিনিও জিয়াউর রহমানকে বড় সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে জানেন বলে জানান।

নাম প্রকাশ না করে একজন এলাকাবাসী জানান, জিয়াউর রহমান আমবাগিচা এলাকায়ই তার বাড়ির কিছুটা সামনে আরেকটি জায়গা কেনার চেষ্টা করছেন। শতাংশের ওই জায়গার প্রতি শতাংশ ৩৫ লাখ করে দাম চেয়েছেন মালিক। জিয়া ভাই ৩২ লাখ টাকা করে দাম বলেছেন। এখন দরকষাকষি চলছে। হয়তো তিনিই জায়গাটা কিনে নেবেন।

গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে প্রতিবেদক পরিচয় জানিয়ে ড্রাইভার জিয়াউর রহমানকে ফোন দিলে তিনি শুরুতে ভালোভাবেই কথা বলেন। কেন ফোন দিয়েছি তা জানতে চান। শিক্ষক নিবন্ধন সনদবাণিজ্য দুর্নীতি করে একাধিক বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি আর ধরেননি। দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর ইস্কাটনে এনটিআরসিএর অফিসে গিয়ে তার খোঁজ করে পাওয়া যায়নি। তবে জানা যায়, তিনি দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অফিসেই ছিলেন। এরপর তাকে আর দেখা যায়নি। সূত্র:দেশ রূপান্তর

 

 

আজকের কাগজ/টিআর