আন্তর্জাতিক ২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০৪:৫৬

আমার ছেলে দোষী হলে তাকেও পুড়িয়ে মারা উচিত: ধর্ষকের মা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক।।

হায়দ্রাবাদে এক তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে হত্যার পর তার মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনায় করা মামলায় অভিযুক্ত এক আসামির মা বলেছেন, তার ছেলে দোষী হলে তাকেও পুড়িয়ে মারা উচিত।
 
ঘটনার তদন্তে নেমে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ। জানা গেছে, হত্যার প্রায় ৩ ঘণ্টা আগে ওই তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যার ছক কষা হয়েছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তরুণীর স্কুটারের চাকা ফুটো করে দিয়েছিল ঘাতকরা। চাকা ঠিক করে দেওয়ার কথা বলে জোরপূর্বক তার স্কুটার সরিয়ে ফেলে তারা। পরে ধর্ষণের আগে ওই তরুণীর মুখ বন্ধ করে তার গলায় মদ ঢেলে দেয় অভিযুক্তরা। তারপর চারজন মিলে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে তাকে। শেষে খুন করে পেট্রল-ডিজেল ঢেলে পুড়িয়ে দেয় মরদেহ।

২৭ নভেম্বরের এ ধর্ষণকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভের মধ্যেই ১ ডিসেম্বর এ নিয়ে প্রথম মুখ খুলেছেন তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও। তিনি জানিয়েছেন, দ্রুত বিচার আদালতেই এ মামলার বিচার সম্পন্ন হবে।

নৃশংসতার শিকার ওই তরুণীর মা আগেই খুনিদের পুড়িয়ে মারা উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। এরপর রবিবার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিওতে এক অভিযুক্তের মাকেও একই দাবি তুলতে দেখা যায়। ওই নারী বলেন, ‘আমার ছেলে দোষী হলে তাকেও পুড়িয়ে মারা উচিত। নিহত তরুণীও তো কারও মেয়ে। এখন আমি কষ্ট পাচ্ছি। বুঝতে পারছি, ওই তরুণীর মা কতটা কষ্ট পাচ্ছেন।’ তবে তিনি কোন অভিযুক্তের মা তা স্পষ্ট নয়।

অন্য এক অভিযুক্ত চিন্তকুন্ত চেন্নাকেশভুলুর মা-ও বলেছেন, ‘ওকে উপযুক্ত শাস্তি দিন। আমারও মেয়ে আছে।’ আরেক অভিযুক্ত জল্লু শিবার মা বলেছেন, ‘যা করা প্রয়োজন বলে মনে হয়, তা-ই করুন। ঈশ্বর জানেন কী হবে।’

পুলিশ জানিয়েছে, চার অভিযুক্তের মধ্যে দু’জন পেশায় ট্রাকচালক। বাকি দুজন ট্রাক থেকে মাল খালাসের কাজ করে। তবে চেন্নাকেশভুলুর মা জানিয়েছেন, তার ছেলে অসুস্থ। তাই ছয় মাস ধরে সে তেমন কাজকর্ম করছে না। তার আর এক আত্মীয় বলেন, ‘ও গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে আমরা মুখ দেখাতে পারছি না।’

ঘটনার দ্রুত বিচারের দাবিতে বিক্ষোভের জেরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে আন্দোলনকারীদের। শামশাবাদের যে কলোনিতে নিহত তরুণী থাকতেন শনিবার সেখানকার মূল ফটকে তালা দিয়ে দেন বাসিন্দারা। রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, সংবাদমাধ্যমকে ঢুকতে না-দেওয়ার সমর্থনে প্ল্যাকার্ডও দেখা যায়। সাবেক সিপিএম বিধায়ক জে রঙ্গা রেড্ডি ও তার সমর্থকেরা কলোনিতে ঢুকতে না-পেরে মূল ফটকের বাইরে ধর্নায় বসে পরিবারের পাশে থাকার বার্তা দেন। পরে অবশ্য তরুণীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন কংগ্রেস দলীয় এমপি এ রেবন্ত রেড্ডি। কলোনির বাসিন্দা এক নারীর প্রশ্ন, ‘এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখনও টুইট করলেন না কেন?’ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও বলেছেন, ‘এ এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে দ্রুত বিচার হবে।’

এদিকে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের পর উল্টো পুলিশি জটিলতায় পড়তে হয় নিহত ওই তরুণীর বোনকে। এক থানা থেকে অন্য থানায় ঘোরানো হতে থাকে তাকে। এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। অভিযোগের মুখে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষেণ রেড্ডি বলেছেন, ‘পুলিশ দায়িত্বে অবহেলা করেছে। প্রতিটি থানা যাতে অভিযোগ নেয় তা নিশ্চিত করা হবে। এফআইআর করার আগেই ওই তরুণীর পরিবারকে সাহায্য করা উচিত ছিল।’

এফআইআর নিতে দেরি করায় সমালোচনার মুখে তিন পুলিশ সদস্যকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। বর্তমানে কারাগারে রয়েছে চার অভিযুক্ত। তবে তাদের নিজেদের হেফাজতে নিতে চায় পুলিশ। একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রয়োজনে কারাগারেই তাদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জেরা করা যেতে পারে।

অভিযুক্তদের পক্ষে কোনও আইনজীবী সওয়াল করবেন না বলে জানিয়েছে রঙ্গা রেড্ডি জেলার বার অ্যাসোসিয়েশন। তবে আদালত জেলার ‘লিগ্যাল অ্যাড সার্ভিস’-এর মাধ্যমে কোনও আইনজীবীকে অভিযুক্তদের পক্ষে সওয়াল করার নির্দেশ দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে ওই নির্দেশ অমান্য করা হবে না বলে জানিয়েছে স্থানীয় বার অ্যাসোসিয়েশন।

টোন্ডাপল্লি টোল প্লাজার কাছে ওই তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ শেষে খুনের পর তার মরদেহ পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় এক পেট্রল পাম্পের কর্মীদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। ওই পাম্পের কর্মীরা চার অভিযুক্তকে বোতলে পেট্রল বিক্রি করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার পর বোতলে পেট্রল বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তেলেঙ্গানা রাজ্য সরকার। কোন পরিস্থিতিতে ওই পাম্পের কর্মীরা বোতলে পেট্রল বিক্রি করেছিলেন তা-ও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।

হায়দ্রাবাদের কাছে শামশাবাদ টোল প্লাজায় গত বুধবার রাতে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। রাস্তায় ট্রাকের কর্মীদের আচরণ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তখনই নিজের বোনকে ফোন করে ওই তরুণী বলেছিলেন, ‘কয়েকজন অচেনা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে। আমার সঙ্গে কথা বলতে থাক।’

কল্লুরু গ্রামের একটি পশু-হাসপাতালে কাজ করতেন ওই তরুণী। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, ঘটনার সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে প্রথমে গোচিবাওলিতে এক চর্মচিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। নিজের স্কুটারটি শামশাবাদ টোল প্লাজার কাছে রেখে ট্যাক্সি নিয়ে ওই চিকিৎসকের কাছে যান তিনি। ফিরে এসে দেখেন, স্কুটারের পেছনের চাকাটি পাংচার।

হায়দ্রাবাদ শহর থেকে শামশাবাদ প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে। তরুণী ওই টোল প্লাজা থেকে রাত সোয়া ৯টার দিকে বোনকে ফোন করে বলেন, দুই ট্রাকচালক তাকে সাহায্য করবে বলছে। তার আপত্তি সত্ত্বেও টায়ার সারিয়ে দেবে বলে স্কুটার নিয়ে চলে গেছে একজন। বোন তাকে পরামর্শ দেন, স্কুটারটি রেখে ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসতে। সে-ই শেষ কথা। পৌনে ১০টার দিকে বোন আবার চেষ্টা করে সেল ফোন বন্ধ পান ওই তরুণীর। পরের দিন সকালে শামশাবাদের আউটার রিং রোডের আন্ডারপাসের নিচে ওই চিকিৎসকের পোড়া দেহাবশেষ মেলে।

হায়দ্রাবাদ পুলিশ বলছে, বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে টোল প্লাজায় তরুণী চিকিৎসককে স্কুটার রাখতে দেখেই তাকে ধর্ষণের ছক কষেছিল চার অভিযুক্ত। সেখানে বসে মদ পান করছিল তারা। তরুণী ট্যাক্সিতে চলে যেতেই স্কুটারের চাকা ফুটো করে দেয় নবীন। ওই তরুণী ফিরে আসার পর আরিফ চাকা সারিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। স্কুটার নিয়ে শিবা চলে যায়। তখন আরিফ, নবীন এবং চিন্তকুন্ত টোল প্লাজার কাছেই একটি ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে তরুণীকে।

চাকা সারিয়ে ফিরে এসে ধর্ষণ করে শিবাও। তরুণীর মুখ চেপে ধরে আরিফ। এরপর স্কুটার নিয়ে কয়েক বোতল পেট্রল কেনে দুজন। অন্য দুজন আরিফের লরিতে করে দেহ নিয়ে যায় আন্ডারপাসে। কিছু ডিজেল বের করা হয় তরুণীর স্কুটার থেকেও। এরপর আন্ডারপাসের এক কোণে মরদেহ নামিয়ে তেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় সংঘবদ্ধ ধর্ষক-খুনিদের দল। পরদিন ভোরে এক দুধ-বিক্রেতা সেখানে দেহটি জ্বলতে দেখে পুলিশে খবর দেন।

সুত্র: আনন্দবাজার।