আন্তর্জাতিক ২১ নভেম্বর, ২০১৯ ১১:৪৫

ইরানের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করছে পাকিস্তান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক।।

পাকিস্তানের সেনা প্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়ার দুই দিনব্যাপী ইরান সফরের বিষয়টি যদিও পাকিস্তানী মিডিয়ায় স্বল্প কাভারেজ দেয়া হয়েছে, তবে এই সফর দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সম্পর্কে অগ্রগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ইরানী পক্ষ এই সফরকে একটা রাজনৈতিক চেহারা দেয়ার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তানী সেনাপ্রধান সেখানে ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ হোসেন বাকেরি ছাড়াও প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভাদ জারিফ এবং সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সেক্রেটারি আলি শামখানির সাথে বৈঠক করেছেন।

সীমান্ত নিরাপত্তা আর সন্ত্রাস দমন ইরানের প্রধান ইস্যু। কিন্তু জেনারেল বাজওয়ার আলোচনায় আঞ্চলিক উন্নয়নের ইস্যুগুলো গুরুত্বের সাথে এসেছে এবং এমনকি মুসলিম বিশ্বের প্রধান ইস্যুগুলোতে দুই দেশের সমন্বয়ের বিষয়টি নিয়েও তারা কথা বলেছেন।

ইরানি রিপোর্টগুলোতে কাশ্মীর ইস্যু বা ভারত-পাকিস্তান ইস্যু নিয়ে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু এটা মনে হয় না যে, জেনারেল বাজওয়া এই বিষয়টি এড়িয়ে যাবেন।

বরং, জেনারেল বাজওয়া সোমবার যেদিন তেহরানের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন, সেদিন পাকিস্তান সেদিন সার্ফেস-টু-সার্ফেস ব্যালিস্টিক মিসাইল শাহীন-১ এর পরীক্ষা চালিয়েছে। এর ঠিক একদিন আগেই ভারত তাদের অগ্নি-টু মিসাইলের প্রথম রাত্রিকালীন মহড়া চালায়।

ইরানি বার্তা সংস্থা ইরনা উল্লেখ করেছে যে, শাহীন-১ উৎক্ষেপনের উদ্দেশ্য হলো আর্মি স্ট্র্যাটিজিক ফোর্সেস কমান্ডের আভিযানিক প্রস্তুতির বিষয়টি পরীক্ষা করা, যেটা পাকিস্তানের ন্যূনতম প্রতিরোধ সক্ষমতা নিশ্চিত করবে”।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মুখপাত্র এই টুইটে লিখেছেন যে, জেনারেল বাজওয়া প্রেসিডেন্ট রুহানির সাথে “আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিবেশ ও পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে” আলোচনা করেছেন। ইরানি বার্তা সংস্থা ইরনার মতে, জেনারেল বাজওয়া রুহানিকে বলেছেন যে, পাকিস্তান ‘সকল ক্ষেত্রে’ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার জন্য প্রস্তুত।

রুহানি আঞ্চলিক শান্তি রক্ষায় পাকিস্তানের ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং দুই মুসলিম দেশের মধ্যেকার সম্পর্ককে ‘অমূল্য সম্পদ’ আখ্যা দিয়ে বলেন, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য এই সম্পর্ককে কাজে লাগাতে হবে।

ইরানি রিপোর্টগুলোতে জেনারেল বাজওয়াকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, পাকিস্তান আর ইরানের সামনে ‘অভিন্ন হুমকি আর অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে’। তিনি এ জন্য দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও বিনিময়ের আহ্বান জানান।

ইরনার এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেহরান ও ইসলামাবাদের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাদের পাল্টাপাল্টি সফর হয়েছে এবং পাকিস্তান সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক ইরান সফরের মধ্যে দিয়ে এই বিষয়টি উঠে এসেছে যে, দুই দেশই সক্রিয় কূটনীতিক তৎপরতার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে আরও জোরালো করতে চায়”।

আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা ফার্স জানিয়েছে যে, জেনারেল বাজওয়া ও জেনারেল বাকেরি “নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও আঞ্চলিক পর্যায়ে স্থিতিশীল নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছেন” এবং “প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরালো করার বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন”।

অ্যাডমিরাল শামখানি – যিনি ইরানের সুপ্রিম নেতা আলি খামেনির কাছে রিপোর্ট করে থাকেন – তিনি পাকিস্তানের সাথে ‘সার্বিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের’ আহ্বান জানিয়েছেন যাতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। একইভাবে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জারিফ ও জেনারেল বাজওয়া ‘রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছেন”।

সন্দেহ নেই যে, ইরানি রিপোর্টগুলোতে সম্মিলিতভাবে ইরান-পাকিস্তান নতুন সম্পর্কের ব্যাপারে উচ্চ প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে।

চাবাহার বন্দর থেকে ভারতের ইউ-টার্ন নেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা গেছে যে, ভারত আঞ্চলিক কৌশলের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ওয়াশিংটন সৌদি আরবে তাদের সামরিক মোতায়েনের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে, যেটা ইরানের সাথে সঙ্ঘাতের একটা কারণ হতে পারে।

ইরানের সিস্তান-বালুচিস্তান প্রদেশেও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো হামলা করে থাকে, যাদেরকে সৌদি আরব মদদ দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তেহরান এটা অনুভব করছে যে, মোদি সরকার ক্রমশই যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলি-সৌদি অক্ষের দিকে আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, যেটা ভারতের আগের স্বাধীন উপসাগরীয় অঞ্চল নীতিকে বদলে দিচ্ছে।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এবং ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব অবশ্যই তেহরানকে সতর্ক করে দিয়েছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তান ভারত-ইরান সম্পর্কের ক্রমাবনতির উপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছে এবং তারা এই হিসেব কষছে যে, ৪০ বছর ধরে ভারত ইরানকে যেভাবে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে, সেটার এখন ইতি ঘটতে চলেছে। এদিকে, ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের মতো প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির প্রশংসা করছে ইরানের নেতৃবৃন্দ।

তেহরান এটা হিসেব কষতে পারে যে, পাকিস্তান-ইরান সামরিক সহযোগিতার জন্য এখন আদর্শ সময়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইরানের সাথে অস্ত্র ব্যবসার ব্যাপারে জাতিসংঘের যে পাঁচ বছর সময়সীমা ছিল, সেটা আগামী বছর শেষ হচ্ছে, আর ইরানের মিসাইল কর্মকাণ্ডের উপর আট বছরের সময়সীমা শেষ হবে ২০২৩ সালে।

অবশ্যই, কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে তেহরানের সমর্থন দেয়ার আগ্রহের বিষয়টিই এখানে সবচেয়ে বড়।

ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইউরেশিয়ার সাথে সমন্বয়ের প্রশ্নে ইরানের যে ব্যাপক পররাষ্ট্র নীতির এজেন্ডা রয়েছে, সেটাই আঞ্চলিক রাজনীতির ক্ষেত্রে তেহরান আর ইসলামাবাদকে একই জায়গায় নিয়ে আসবে।

তেহরানে সম্প্রতি এক বৈঠকে সফরকারী একদল ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিকের কাছে জারিফ স্বীকার করেছেন যে, মার্কিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ চীন, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে একটা ‘বোঝাপড়া’ তৈরি করেছে। এই দেশগুলো সবাই নিজেদেরকে ‘মার্কিন টার্গেট’ মনে করছে এবং দেশগুলোর নেতারা নিজেদেরকে অভিন্ন অবস্থানে দেখতে পাচ্ছেন। ইসলামাবাদও নিশ্চয়ই এ বিষয়ে অবগত রয়েছে, কারণ তারা এখানে ‘টার্গেট’ হয়ে আছে।

সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর