জাতীয় ২০ নভেম্বর, ২০১৯ ০৪:৪৯

পাহাড়ে বন্ধ হচ্ছে না রক্তপাত, সমাধান কি ?

ডেস্ক রিপোর্ট ।।

পাহাড়ে বন্ধ হচ্ছে না রক্তপাত। প্রায় প্রতিমাসেই ঝরছে তাজা প্রাণ। এই রক্তপাত বন্ধের জন্য গত মাসে দুই দিনব্যাপী হাই-প্রোফাইল সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে রাঙামাটিতে। সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যারা চাঁদাবাজি করছে, খুন করছে, অযথা রক্তপাত করছে; তাদের ভয়ঙ্কর দিন আসছে।’ সেই সভার পর পাহাড়ে বসবাসকারীদের মনে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করলেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে আবারও কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে।

১৬ ও ১৭ অক্টোবরের সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, ডিজিএফআই মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদিন, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাফিন আহমেদ, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাহুল ইসলামসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

এই দীর্ঘ সভার ৫ দিনের মাথায় ২২ অক্টোবর আবারও রক্তাক্ত হয়েছে পাহাড়ের মাটি। রাজস্থলী উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ও হেডম্যান দীপাময় তালকুদারকে অপহরণের পর গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরদিন সকালে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত দীপাময় তালকুদার উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ছিলেন।

এরপর ১৮ নভেম্বর একই উপজেলায় ২ নং গাইন্ধ্যা ইউনিয়নের বালুমুড়া মারমাপাড়া এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) ৩ সদস্য নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাঙামাটি পুলিশ সুপার আলমগীর কবির।

এর আগে, ১০ নভেম্বর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও হানাহানি বন্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলের প্রধান তারিন্দ্র চাকমা (পেলে)। তাদের এই আহ্বানকে স্বাগত জানিয়ে বিভিন্ন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয় প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। কিন্তু এরপরও খুনের ঘটনা ঘটায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে- পাহাড়ে বিবাদমান প্রধান তিনটি আঞ্চলিক দল সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানানোর পরও এই রক্তপাতের কারণ কী? আর এর সমাধানই বা কী?

দুই জোটে সক্রিয় চার দল

পাহাড়ে মূলত চারটি দল থাকলেও আঞ্চলিকভাবে তারা দুই ভাগে বিভক্ত। শান্তি চুক্তির পক্ষে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং চুক্তিবিরোধী প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এখন এক হয়ে কাজ করছে। সুধাসিন্ধু খীসার নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা) এবং শ্যামল কান্তি চাকমার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এক হয়ে কাজ করছে বলে এলাকাবাসী মনে করে।

জেএসএস ভেঙে বাকি তিন দলের জন্ম যেভাবে  

দুই দশক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়; যা পরে ‘শান্তি চুক্তি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার মধ্যে এই চুক্তি সই হয়। সেই সময় গেরিলা বাহিনীর নেতা ও তার সব সদস্যরা সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দেয়। চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ের মানুষের মধ্যে শান্তির বাতাস বইতে শুরু করে। কিন্তু চুক্তির বিরোধিতা করে সন্তু লারমার সংগঠন থেকে বের হয়ে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হয়। ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ।

এরপর ২০১০ সালে আবারও ভাঙে জেএসএস। সন্তু লারমার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে নানা অভিযোগে সুধাসিন্ধু খীসা ও তারিন্দ্র লাল চাকমা (পেলে)’র নেতৃত্বে জম্ম হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নতুন গ্রুপ (জেএসএস-এমএন লারমা)।

সর্বশেষ, ২০১৭ সালে ভেঙে যায় জেএসএস ভেঙে ১৯৯৮ সালে জন্ম নেওয়া ইউপিডিএফ। নভেম্বরে খাগড়াছড়ি জেলায় সাংবাদিক সম্মেলন করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ভেঙে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামের নতুন সংগঠন জন্ম নেয়। ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক এর আত্মপ্রকাশের পর এখন পাহাড়ে চারটি আঞ্চলিক দলের তৎপরতা রয়েছে।

পাহাড়ে সংঘাতের নেপথ্যে কী, সমাধান কী

ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলের সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা বলেন, ‘প্রসীত খীসার ইউপিডিএফ-এর জন্য আজ পাহাড়ে এতো সংঘাত। তারা তখন চুক্তির বিরোধিতা না করলে হয়তো পাহাড়ে আজ চারটি আঞ্চলিক সংগঠন হতো না।’

তিনি আরও বলেন, ‘পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ হোক, এটা আমরা সব সময় চাই। এজন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু সন্তু লারমার জেএসএস ও প্রসীত খীসার ইউপিডিএফ-এর কারণে এটি বন্ধ হচ্ছে না। তারা মুখে হানাহানি বন্ধের কথা বললেও সাধারণ পাহাড়িরা তাদের কথা বিশ্বাস করে না। তারা উভয়ে বিশ্বাসঘাতক।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা)-এর তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, ‘পাহাড়ে কোনও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমাদের দল জড়িত ছিল না। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে যাচ্ছি। চুক্তি বাস্তবায়ন হলে যাদের বেশি ক্ষতি হবে, তারাই চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা তৈরি করছে। আমরাও চাই পাহাড়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজমান থাকুক। সবাই নিরাপদে শান্তিতে বসবাস করুক।’

এদিকে ইউপিডিএফ এর যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি অংগ্য মারমা বলেন, ‘শাসক গোষ্ঠীর কারণে পাহাড়ে সংঘাত বন্ধ হচ্ছে না। গত ১০ নভেম্বর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় জেএসএস ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর আহ্বানকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু তারপরও কিছু বন্ধ হচ্ছে না।’  

এই ব্যাপারে কথা বলার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) উপজেলা, জেলা এবং কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।

রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির জানিয়েছেন, ‘সোমবার যাদের মৃত উদ্ধার করা হলো, আমরা আলতম সংগ্রহ রেখেছি। রাঙামাটিতে গত মাসে হাই প্রোফাইল সভা হয়েছে। সভায় কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং সেসব বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আশাকরি এসব বাস্তবায়ন হয়ে গেলে হত্যাকাণ্ড কমে আসবে।’