শিক্ষা ২৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০৮:০৮

জীবনে বলার মতো একটা গল্প থাকা দরকার

সিফাত কবীর 

জীবনে বলার মতো একটা গল্প থাকা দরকার। ফেসবুকের ইনট্রোতে এমনটি লিখে রেখেছেন আলাদিন ডটকমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইকবাল বাহার। এ ছাড়া তিনি অপ্টিম্যাক্স কমিউনিকেশন লিমিটেডের ডিরেক্টর এবং সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সংবাদ পাঠক এবং উদ্যোক্তাবিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বৈশাখী টেলিভিশন এবং এশিয়ান টেলিভিশনে। এর আগে তিনি সিঙ্গার বাংলাদেশের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এর আগে গ্রামীণ শক্তির এবং গ্রামীণ সাইবার নেট লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আজ থেকে ১৫ বছর আগে যখন মানুষ ক্যারিয়ার কিংবা খণ্ডকালীন জব নিয়ে অতটা সচেতন ছিল না তেমন সময়ে ইকবাল বাহার ছাত্র অবস্থায় চাকরিতে জয়েন করেন। সময়ের বিবর্তনে নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছেন। তারই ক্যরিয়ারের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিকগুলো জানার চেষ্টা করেছি এ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন কর্পোরেট আস্কের সিইও এবং রিসিউম ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট নিয়াজ আহমেদ।

চাকরির খোঁজ : আপনার ক্যরিয়ারের শুরুর দিকের গল্পটা শুনতে চাচ্ছিলাম?

ইকবাল বাহার : আমি গ্রামের স্কুলে পড়েছি। পড়াশোনার ভিত্তি শহরের ছেলেমেয়েদের মতো অতটা ভালো ছিল না। আমি আমার বড় চাচার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতাম এবং ছোটবেলা থেকেই বড় চাচা আমার ইংলিশে ব্যাপারে যতœশীল ছিলেন। এসএসসি পরীক্ষার পর ঢাকায় এসে তিতুমির কলেজে ভর্তি হই। তবে বিভিন্ন টানাপোড়েনের কারণে এইচএসসি পরীক্ষাতে পাস করতে ব্যর্থ হই। এরপর চারদিক থেকে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শিরা আমাকে নিয়ে মজা করে, টিপ্পনি কাটে। একটা সময় আমি কিছুটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর। কিন্তু এইচএসসিতে আমার ফলাফল এতটাই খারাপ ছিল যে কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি পরীক্ষাই দেয়ার সুযোগ পাইনি। বিকম পড়তে আবার তিতুমির কলেজে এসে ভর্তি হই। বিকম পড়ার পাশাপাশি টিউশন শুরু করি। সেই অল্প অল্প করে জমানো টিউশনির টাকাই ছিল প্রথম জীবনে আমার ব্যবসার প্রথম মূলধন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর মামার পরামর্শে সিএ পড়তে যাই। সিএ পড়তে গিয়ে আমার মাথা খুলে যায়। তখন আমি একটি ফার্মে চাকরিতে ঢুকে পড়ি। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত হই। প্রথম জীবনের এ ব্যর্থতাগুলোকেই আমার ক্যরিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করি।

চাকরির খোঁজ : উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা কীভাবে মাথায় আসে?

ইকবাল বাহার : হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, হিসাববিজ্ঞান বিভাগে কাজ করতে আমার আসলে ভালো লাগে না। আমি সবগুলো বিভাগে কাজ করতে চাই। আমি পণ্য প্রস্তুত, বিক্রয়, বিপণন এবং সেবাদান বিভাগেও কাজ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট কোম্পানিতে বিভাগীয় পর্যায়ে চাকরিরত অবস্থায় অন্য বিভাগগুলোয় কাজ করার সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই ভেবে দেখলাম সব বিভাগে কাজ করতে হলে অন্যের কোম্পানিতে কাজ করা যাবে না, নিজেকে একটা কোম্পানি তৈরি করে নিতে হবে। এ ছাড়া আমার ৯টা থেকে ৫টা অফিস করতে ও ভালো লাগছিল না। অফিস শেষে প্রচুর অবসর। কিন্তু করার মতো তেমন কোনো কাজ নেই। তখন চিন্তা করলাম আমি আসলে কোন কাজটি ভালো পারি আর কোন কাজটি করতে ভালো লাগে। এক সময় আমি আবিষ্কার করলাম প্রযুক্তির দিকেই আমার প্রধান ঝোঁক। তাই কয়েক বন্ধু মিলে একটি ব্যবসা শুরু করি।

কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিয়ে কেউই কোম্পানির হাল ধরতে পারছিলাম না। এ ছাড়া শুরুতে ফান্ডিংও পাচ্ছিলাম না। আস্তে আস্তে ২ বছর চলার পর কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন আমিই চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে কোম্পানির হাল ধরার মতো ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিই। যদিও ততদিনে কোম্পানির অনেক শেয়ারহোল্ডাররা ত্যাগ করে। তবে কোম্পানির হাল ধরার পর আমার আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২ বছর আগেই আলাদিন ডটকম নামে নতুন কোম্পানি শুরু করি। এটি মূলত ই-কমার্স বিজনেস। আলাদিন ডটকমকে বাংলাদেশের আলিবাবা ডট কম করাই আমার লক্ষ্য।

চাকরির খোঁজ : উদ্যোক্তাদের নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?

ইকবাল বাহার : নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের নতুন উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। দেশের ৬৪টি জেলা থেকে ১৬৪ জন নতুন উদ্যোক্তাকে নির্বাচন করেছি এবং তাদের জন্য অনলাইনে ৩ মাসব্যাপী কোর্স চালু করেছি। এসব উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা এবং তাদের ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দেয়ার জন্য যা করার আমি তা চেষ্টা করব। আমি মনে করি এই সমাজ এই দেশ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। এখন আমার ফেরত দেয়ার পালা।

চাকরির খোঁজ : বাংলাদেশে উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পথে প্রধান সমস্যাগুলো কী কী?

ইকবাল বাহার : প্রথমত মানুষের থাকতে হবে অদম্য ইচ্ছাশক্তি। এরপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ফান্ডিং। আমি সরকারকে অনুরোধ করব সরকার যেমন বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ প্রজেক্ট করছেন তেমনি যেন অন্তত ৫০০০ নির্বাচিত উদ্যোক্তাকে সহজ শর্তে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুদান প্রদান করেন। কম্পিউটার শিখতে হলে যেমন উল্টাপাল্টা টিপে দু-একবার এটাকে নষ্ট করতে হয়, তেমনি ব্যবসায় কীভাবে আর্থিক লেনদেন হয় সেটা শিখতে গিয়ে ২-৪ জন যদি ক্ষতিগ্রস্তও হয় তবু ও তাদের এই তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের বহুদূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আমার বিশ্বাস প্রতিটি উদ্যোক্তা ও সরকারি অনুদান গ্রহণের পর ব্যবসায় এ সফল হয়ে সরকারকে প্রতিটি টাকা ফিরিয়ে দেবে।

চাকরির খোঁজ : উদ্যোক্তাদের সফল না হওয়ার পেছনে প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী?

ইকবাল বাহার : অনেক উদ্যোক্তাই সফল হতে পারেন না। এর পেছনে প্রধান কারন হল- লেগে না থাকা। এ ছাড়া অনেকে যে কাজটা জানেন না, বোঝেন না এবং পারেন না, অন্যকে দেখে লোভে পড়ে সেই কাজ করার চেষ্টা করা। দ্রুত মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে বারবার লক্ষ্য পরিবর্তন করা উদ্যোক্তাদের সফল না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।

চাকরির খোঁজ : নতুন উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন আনা উচিত?

ইকবাল বাহার : একটা সময়ে স্কুলে অলিখিত একটা নিয়ম ছিল যারা ভালো ছাত্র তারা সবাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়বে। অর্থাৎ তারা ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হবে। যারা গড়ে ৪০-৫০ নম্বর পেতেন ও ইংরেজিতে ফেল করতেন তারা বাণিজ্য বিভাগে পড়বে অর্থাৎ তারা ব্যাংক-অফিসের হিসাব-নিকাশের চাকরি করবে। আর যাদের একমাত্র আশা ভরসা বা স্বপ্ন ৩৩ নম্বর, তারা মানবিক বিভাগে পড়বে অর্থাৎ সরকারি চাকরি করবে বা স্কুল-কলেজে মাস্টারি করবে। বলে দেয়ার কেউ ছিল না যে তাদের আসলে কী করা উচিত বা কী পড়া উচিত। বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং ধীরে ধীরে টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের প্রসারের কারণে এ ধারণা বদলেছে। এখন মেধাবীরা শুধু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নয়, তারা চার্টার্ড অ্যান্ড কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, এমবিএ, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি পড়ছে। তরুণরা এখন নিজেরাই নানারকম তথ্য এনালাইসিস করতে পারছে কোথায় তাদের পড়া উচিত। বাবা-মা’রাও তাদের সিদ্ধান্ত সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা কমিয়েছে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে সবাই হুজুগে দৌড়ায়। এক একবার একেকটার জোয়ার আসে তো সবাই সেটাতে গা ভাসিয়ে দেয়। শিক্ষা বাণিজ্যিকরাও সেই সুযোগটা লুফে নেন। ২-৪টা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বাদ দিলে বাকি ইউনিভার্সিটিগুলোর মান নিয়ে কথা নাই বা বললাম। এত বিবিএ-এমবিএ দিয়ে হবেটা কী? কারা চাকরি দেবে, কোথায় চাকরি পাবে আমাদের তরুণরা! যে ছেলেটা বা মেয়েটা ক্রিকেট খেলবে, গান করবে, অভিনয় করবে, ফটোগ্রাফার হবে, বড় রন্ধনশিল্পী হবে, ডিজাইনের কাজ করবে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট করবে, হোটেলে কাজ করবে, মার্চেন্ডাইজিংয়ের কাজ করবে, আধুনিক কৃষিভিত্তিক কাজ করবে- সে কেন বিবিএ, এমবিএ বা ভূগোল পড়বে! খেলা, গান, ডিজাইন, ফটোগ্রাফি, মার্চেন্ডাইজিংসহ এসব বিষয়ের ওপর তারা গ্র্যাজুয়েশন করবে, প্রয়োজনে মাস্টার্স করবে।

দরকার এসএসসির পর থেকেই কারিগরি শিক্ষা। যারা গত ১৫-২০ বছরে শতশত প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বানিয়ে এমবিএ ও বিবিএ সার্টিফিকেট বিক্রি করেছেন এবং আমাদের তরুণরা সেই সনদ দিয়ে কোনো চাকরি বা উদ্যোক্তা হতে পারেনি। তাদের অনুরোধ করব আপনারা এবার কিছু আধুনিক কারিগরি কলেজ-ইউনিভার্সিটি বানান যাতে আমাদের মেধাবী ও কর্মঠ তরুণরা এসএসসির পর থেকেই হাতেকলমে কাজ শিখতে পারে ও ওইসব বিষয়ে প্রয়োজনে ডিগ্রি নিতে পারে।

চাকরির খোঁজ : আপনার কাছে সফলতার মানে কী?

ইকবাল বাহার : মানুষ এখন সফলতার পেছনে এমনভাবে ছুটছে, অনেকেরই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন থেকে সুখ জিনিসটা দিনেদিনে দূরে সরে যাচ্ছে। আমার মতে সব সুখী মানুষই সফল, কিন্তু সব সফল মানুষ সুখী নয়। সফলতার মানে হচ্ছে সুখে থাকা, একজন ভালো মানুষ হওয়া এবং এমন কিছু করা যা অন্য একজনকে সুখী করতে পারে। সুখেই সফলতার সার্থকতা।

চাকরির খোঁজ : কোন ৩টি কারণে একজন উদ্যোক্তা হয়ে আপনি গর্ববোধ করেন?

ইকবাল বাহার : এক. আমার কোম্পানিতে আমার সঙ্গে আরও ১৫০ জন মানুষ কাজ করছে। যে কোনো প্রয়োজনে সবার অভিভাবক আমি। এতগুলো পরিবারের মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পেরে আমি গর্ববোধ করি। দুই. উদ্যোক্তা হওয়ার কারণে আমি সৃষ্টিশীল কাজ করার সুযোগ পাই। তিন. উদ্যোক্তা হয়েছি বলেই আজ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারি।

চাকরির খোঁজ : তরুণদের উদ্দেশে আপনার দেয়া দিকনির্দেশনা কী কী?

ইকবাল বাহার : কঠোর পরিশ্রমের কোনো শর্টকাট নেই। ২১ থেকে ২৮ বছর পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ক্যারিয়ারের প্রত্যেকটি ধাপেই সততা বজায় রাখতে হবে। সত্য কথা বলতে হবে। সত্য কথা বলার একটা বড় উপকার হল আগেরবার কী বলেছেন তা মনে রাখতে হয় না। অসাধু ব্যক্তি সাময়িকভাবে সফল হতে পারে, কিছুদিনের জন্য এগিয়ে থাকতে পারে, তবে দিন শেষে সৎ লোকেরাই শেষ হাসি হাসে।

লিখেছেন ইকবাল বাহার