লাইফ স্টাইল ৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৮:৪৯

যেভাবে বিবিসির অনুপ্রেরণাদায়ী ১০০ নারীর তালিকায় সানজিদা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ময়মনসিংহের সানজিদা ইসলাম ছোঁয়া এ বছর বিবিসি প্রকাশিত বিশ্বের অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। জেলার নান্দাইল উপজেলার আচারগাঁও ইউনিয়নের ঝাউগড়া গ্রামে বাড়ি তার। তিনি কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোঁয়ার মায়েরও বাল্যবিয়ে হয়েছিল। পাশাপাশি তার অনেক সহপাঠীও এই কুপ্রথার শিকার। বিষয়টি ভীষণ আলোড়িত করে তাকেও।

মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) এই তালিকা প্রকাশিত হয়। বিবিসি বাংলা মোবাইল ফোনে এই খুশির খবর জানায় সানজিদা ইসলাম ছোঁয়াকে। ছোঁয়ার এই অর্জনে কেবল তিনি ও তার পরিবারই নন, খুশি পুরো এলাকাবাসী।

এক অনন্য অর্জন
বিবিসির তালিকায় ছোঁয়ার নাম রয়েছে ২১ নম্বরে। এছাড়া  এই তালিকায় আছেন ফিলিস্তিনের নারী আল জাজিরার সাংবাদিক লিনা আবু আকলেহ। ইসরায়েলি বাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। এতে আরও আছে- সিরিয়ার শারীরিক প্রতিবন্ধী দৌড়বিদ দিমা আক্তা, ইরানি অভিনেত্রী জার আমির ইব্রাহিমি, আফগানিস্তানের শিক্ষার্থী ফাতিমা আমিরি, মিয়ানমারের চিকিৎসক আই নাইন তো, রুশ সাংবাদিক তাইসিয়া বেকবোলাটোভা এবং ভারতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার নাম।

ছোঁয়ার বিষয়ে বিবিসির ভাষ্য, শিক্ষার্থী হিসেবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তার ভূমিকা অনন্য। নান্দাইল পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সময় সাত সহপাঠীকে নিয়ে তিনি গঠন করেন ‘‘ঘাসফড়িং'' নামে একটি সংগঠন। পরবর্তীতে তিনি সংগঠনের বাইরে নিজে প্রায় ৫০টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেন। এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিবিসির ১০০ নারীর তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়।

সাফল্যে খুশি পুরো এলাকাবাসী
এমন সাফল্যের খবরে ছোঁয়াদের বাড়িতে ভিড় করেছেন আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীরা। সবাই তাকে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসাচ্ছেন। আনন্দে আত্মহারা ছোঁয়া। 

ছোঁয়া বলেন, “কাজের স্বীকৃতি পেলে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু এতো বড় স্বীকৃতি যেন নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকছে।”

তিনি আরও বলেন, “মঙ্গলবার সকালে কল করে বিবিসির পরিচয় দিয়ে বলা হয়, আমি বিশ্বের ১০০ নারীর তালিকায় আছি। শুনে রীতিমতো হতবাক হয়ে যাই। এই তালিকা কী, কেন জানার ইচ্ছে হলেও আমি প্রশ্নটি করতে পারছিলাম না। প্রথমে বাড়ির বাইরে থাকা মা-বাবাকে ফোন করে বিষয়টি জানাই। তারাও তখন বিষয়টি আমলে নেননি।”


“এরপর আমার মোবাইল ফোনে একটি লিংক পাঠানো হয়। যা দেখে আমি আবার বিস্মিত হই। তালিকায় আমার আগে রয়েছে ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রীর প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার নাম। যা অবিশ্বাস্য!”

শুরুর গল্প ও পথচলার প্রতিবন্ধকতা

ছোঁয়া জানান, তার মা লিজা আক্তারের বাল্যবিয়ে হয়েছিল। ফলে তিনি চোখের সামনে দেখেছেন বাল্যবিয়ের কুফল। সবসময়ই মা থাকেন অসুস্থ। তিনি স্কুলে পড়ার সময়ও সহপাঠীদের বাল্যবিয়ের শিকার হতে দেখেছেন।

এসব ঘটনা থেকে সহপাঠীদের নিয়ে গঠন করেন একটি সংগঠন। আর এই সংগঠনের সাত সদস্যকে নিয়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে নামেন ছোঁঢা। এককভাবে অনেক সময় সম্ভব না বিধায় দ্বারস্থ হতেন প্রশাসন ছাড়াও স্থানীয় একজন সাংবাদিকের। তাদের নিয়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করে ব্যাপক আলোচনায় আসেন নান্দাইলের এই শিক্ষার্থী। 

ছোঁয়ার মা লিজা আক্তার বলেন, “মেয়ের এই কাজ নিয়ে অনেক সময় হুমকি-ধমকিও শুনতে হয়েছে। কারণ বাল্যবিয়ে বন্ধের বিষয়টিকে সমাজের একটি অংশ এখনও ভালো চোখে দেখে না। তবুও নিজের অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করে মেয়েকেই উৎসাহ দিতাম। আর সে তা সে বীরদর্পেই করে গেছে। এজন্যই আজ তার এ সাফল্য। তার এই অর্জনে অনেকেই উৎসাহ পাবে।”

সাফল্য এলো
 

ছোঁয়ার কাজ সম্পর্কে বিবিসিতে প্রকাশিত হয়, “বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বাল্যবিবাহ-প্রবণ দেশ, তবে সানজিদা ইসলাম ছোঁয়া এই ধারা বদলানোর চেষ্টা করছেন। তার মায়েরও বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে। স্কুলে বাল্যবিবাহের প্রভাব নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন দেখে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হন তিনি।”

অদম্য ছোঁয়া এবং এই কাজে তাকে সহায়তা করা তার বন্ধু, শিক্ষক ও সহযোগীরা নিজেদের “ঘাসফড়িং” হিসেবে পরিচয় দেন। বাল্যবিয়ের ঘটনা শুনলে তারা পুলিশকে জানান। এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী হয়েও ছোঁয়া তার সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। দলের নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। 

এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ভূমিকা রেখেছে ছোঁয়াদের ঘাসফড়িং।

নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল মনসুর বলেন, “সানজিদা ইসলাম ছোঁয়ার সাফল্য নান্দাইলবাসী এমনকি সারাদেশের জন্য গর্বের। তিনি একা অর্ধশত বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন। আমি মনে করি এ কাজে তার পাশাপাশি সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। উপজেলা পরিষদ তাকে বিভিন্ন সময় সহায়তা করেছে এবং ভবিষ্যতেও করে যাবে।”

আমাদেরকাগজ/ এইচকে