সারাদেশ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০৫:১৩

যার হাত ধরে জঙ্গল হল গোলাপ গ্রাম

ডেস্ক রিপোর্ট

রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ৩০ বছর আগেও তুরাগ নদ ঘেঁষা এই ইউনিয়নের ৩২ থেকে ৫৩ গ্রামের প্রায় ৩৩শ হেক্টর জমি পতিত ছিল

ঝোঁপঝাড় আর জঙ্গলে ভরা এসব জমি অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়ায় সেচ সুবিধা তেমন ছিল না এ কারণে এসব জমিতে চাষাবাদ হতো না বললেই চলে নব্বই দশকের শেষ দিকে এই জমিতে ফুলের চাষ শুরু করেন রাজধানীর মিরপুরের নবাবেরবাগ এলাকার সাবেদ আলী পেশায় মালী সাবেদের ছিল গোলাপের প্রতি অকৃত্রিম টান সেখান থেকেই ওই এলাকায় তিনি গড়ে তোলেন গোলাপের বাগান

সাবেদের শুরুর ১০ বছর পর বিরুলিয়া ওই গ্রামগুলোর পতিত জমিতে ঘটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন একে একে ফুল চাষে উৎসাহী হয়ে ওঠেন স্থানীয়রা গ্রামগুলো পরিচিতি পায় ‘গোলাপ গ্রাম’ হিসেবে

প্রথমদিকে মানুষ সাদুল্ল্যাপুরকে গোলাপ গ্রাম নামে চিনলেও বর্তমানে শ্যামপুর, মোস্তাপাড়া, বাগনীবাড়ী, কাকাবো, ছোট ও বড় কালিয়াকৈরসহ পাশে ইউনিয়নের বনগাঁও ৩২ থেকে ৫৩ গ্রামই এ নামে পরিচিত

এক সময়কার নির্জন জঙ্গলের জনপদ সাবেদের কল্যাণে হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যের লীলাভূমি প্রতিদিনই দূর-দুরান্ত থেকে অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসব গোলাপ গ্রামে যান ও হাজার হাজার দর্শনার্থী বাগান থেকে ফুল তুলছেন চাষীরা

সাভার উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিরুলিয়ার লাল মাটিতে প্রায় নয় শত হেক্টর জমিতে এখন চাষ হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল যার সিংহভাগই গোলাপ এসব গ্রামে চাষ হয় চায় না গোলাপ, মিরিন্ডা গোলাপ, ইরানি গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকাসহ নানা জাতের ফুল

প্রথম দিকে ঝাঁকা বোঝাই করে তুরাগ নদে খেয়া পার হয়ে রাজধানীর কাঁটাবনে ভোররাতে ফুল নিয়ে যেতেন চাষিরা আর সেই সাথে ২০১১ সালের পর থেকে বিরুলিয়ার ছোট কালিয়াকৈরে প্রতি রাতে বসে বিশাল ২টি ফুলের হাট এক বাজারে সম্ভব না হওয়ায় পরে কয়েক কিলোমিটার দূরে মোস্তাপুর গ্রামে শুরু হয় আরেকটি হাট

সারা বছর নানা আয়োজনে চাহিদা থাকলেও ফুল বিক্রির অন্যতম মৌসুম পয়লা ফাল্গুন থেকে পয়লা বৈশাখ পর্যন্ত ভালো লাভের আশায় ফুল চাষিরা এ সময়টির জন্য অপেক্ষা করেন

উপজেলা কৃষি অফিস বলছে, গত বছর এই মৌসুমে বিরুলিয়া থেকে ২০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছিল কিন্তু করোনার প্রকোপে এ বছর ১০০ থেকে ১২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে

রাজধানীর মিরপুরের নবাবেরবাগ এলাকার সাবেদ আলী প্রথম বিরুলিয়ায় এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ শুরু করেন
১৯৭৯ সালে ১৬ বছর বয়সে সাবেদ জাতীয় চিড়িয়াখানার এক পরিচালকের বাসভবনের সহকারী মালি হিসেবে কাজ শুরু করেন সেখানে সব ধরনের ফুল গাছের পরিচর্যা করতেন সাবেদ তবে গোলাপের প্রতি ছিল তার বাড়তি আকর্ষণ রপ্ত করেন গোলাপ চাষ ও পরিচর্যার পদ্ধতি সেই থেকে নিজের বাড়িতে একটি গোলাপ বাগানের স্বপ্ন দেখতেন সাবের তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৮৯ সালে বিরুলিয়ার সাদুল্ল্যাহপুর গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষ শুরুর মধ্য দিয়ে

সাবেদ আলী জানান, ১৯৮৯ সালে সাদুল্ল্যাহপুর এলাকায় ২০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষ শুরু করেন তিনি তবে প্রথম স্থানীয়দের এ বিষয়ে তেমন ধারণা না থাকায় অনেকেই তাকে উপহাস করতেন কিন্তু যখন তার বাগানের প্রচুর গোলাপ ফুটতে শুরু করে এবং তা রাজধানীর শাহবাগের পাইকারি বাজারে ভাল দামে বিক্রি করেন, এরপরই টনক নড়ে সবার


তিনি আরও জানান, পরের বছর আরও ৩০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে বাগানের পরিধি বাড়ান তিনি তার দেখাদেখি স্থানীয় কৃষকরাও ফুল চাষে আগ্রহী হন তিনিও স্থানীয় চাষিদের ফুল চাষ সম্পর্কে ধারণা দেয়া ও সহযোগিতা করেন
সাবেদ আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাদুল্ল্যাহপুরে প্রত্থম আমি পরায় (প্রায়) ২০ শতাংশ জমি পত্তন (ইজারা) নিয়া চাষ শুরু করছি তখন আমার দেখাদেখি আশপাশের লোকজন তারা এই কাজ শুরু করে ওনারা (স্থানীয় চাষি) আমার কাছ থাইকা চারা কিন্না নিতো পরে ওনারা নিজেরাই তৈয়ার করত

‘আমি গোলাপ, গ্লাডিওলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ কয়েকটা আইটেম নিয়া পাকি চারেক জমিনে এখন চাষ করতাছি মিরপুর থাইকা এখানে আইসা চাষ করতাছি হাজারের ওপর চাষি এখন এই সাভারে চাষ করতাছে

স্থানীয় বনগাও এলাকার চন্ডিপাড়া গোলাপ চাষি মো. হান্নান মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনেক বলেন, ‘আমি প্রায় ১৬ বছর আগে এহানে গোলাপ চাষ শুরু করছি সাবেদ ভাইরে দেইখায় এই এলাকায় সবাই গোলাপ বাগান করছে আমিও তার দেখাদেখিই করছি

‘এহন ৬০ পাখি (শতাংশ) জমিতে আমি গোলাপ চাষ করতাছি আগে আমার ফ্যামিলিতে অভাব আছিল গোলাপ চাষ শুরু করার পরে এহন আল্লার রহমতে আমি ভালো আছি

সোহেল হোসেন নামে আরেক চাষি বাংলাদেশ প্রতিদিন বলেন, ‘আমাদের এলাকায় সব ধরনের ফুল চাষ হয় কিন্তু আমরা ওই রকম সুবিধা পাইতাছি না আমাদের ফুল কাইটা শাহবাগে নিয়া বেচতে হয় ‘আমাদের এখান থাইকা এয়ারপোর্ট কাছে যদি আমাদের ফুলডা বাগান থাইকা সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করা যাইতো, তাহলে আমর বেশি লাভবান হতাম

সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজিয়াত আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনেক বলেন, ‘এই বছর করোনার কারণে মাঝখানে ফুল বিক্রি হয়নি এখন আবার বিক্রি হচ্ছে তবে স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিক্রিটা আগের বছরের মতো এতটা হবে না জাতীয় প্রোগ্রামগুলোও ওইভাবে হচ্ছে না গত বছর এই মৌসুমে ২০০ কোটি টাকার মতো ফুল বিক্রি হয়েছিল কিন্তু এ বছর আমরা আনুমানিক হিসাব করেছি ১০ থেকে ১২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে