মুক্তমত ২১ জানুয়ারি, ২০২১ ০৭:৫১

অনলাইন সাংবাদিকতা ও পেশাদারিত্ব

দেব রায় দীপ্ত

সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা পেশা হিসেবে সংবেদনশীলতা সাংবাদিকতাকে অন্য সকল পেশা থেকে আলাদা করেছে সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির দর্পণ স্বরূপ সাংবাদিকতা যেমনি মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করে তেমনি এর একটি ভুল সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আনতে পারে চরম দুর্ভোগ

সাংবাদিকতা শাস্ত্রের পণ্ডিতগণ মনে করেন, একজন পেশাদার সাংবাদিককে অবশ্যই সংবাদ সংগ্রহ, লিখন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে যেমনি দক্ষতা প্রদর্শন করতে হয়, তেমনি মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের সুষ্ঠু প্রয়োগও অপরিহার্য আর এগুলোর ঘাটতি থাকলে সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যায়

মানুষ স্বভাবতই তরতাজা জিনিস পছন্দ করে সংবাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয় আগে একদিনের ঘটনা পরের দিন জানতে পারতো মানুষ। কোনো কোনো সময় দু-তিন দিনও পার হয়ে যেতো সংবাদ পৌছেতে তবে অনলাইন সংবাদ আসার ফলে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে মানুষ এখন সাথে সাথে খবর জেনে যাচ্ছে

আধুনিক এই যুগে পৃথিবীর যে প্রান্তেই ঘটনা ঘটুক না কেন তা মুহূর্তের মধ্যে আমাদের নাগালে চলে আসছে সেই খবর তখনই পাঠকের জন্য পরিবেশন করা হচ্ছে এই গোটা প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে অনলাইন পত্রিকা, আরও নির্দিষ্ট করে বললে অনলাইন সাংবাদিকতা

অনলাইন সাংবাদিকতা অর্থাৎ ডিজিটাল সাংবাদিকতা সম্পর্কে একটা ধারণা নেওয়া যাক

অনলাইন সাংবাদিকতা হচ্ছে, হালের সাংবাদিকতার একটি ধরন যার বিষয়বস্তু কাগজ বা সম্প্রচার মাধ্যমের বদলে ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয় ডিজিটাল সাংবাদিকতার সংজ্ঞা নিয়ে অবশ্য যথেষ্ট বিতর্ক আছে খবর বা ফিচার যখন পাঠ্য বিষয়, অডিও, ভিডিও ও ইন্টারঅ্যাকটিভিটির সহায়তায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে আমরা অনলাইন বা ডিজিটাল সাংবাদিকতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি

ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় ১৯৭৪ সালে ব্রুস পারেলউ ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনলাইন সংবাদপত্র চালু করেন ১৯৮৭ সালে শুরু হওয়া সরকারি মালিকানাধীন ব্রাজিলীয় সংবাদপত্র ‘জর্নালদোদিঅ্যা’ ৯০ দশকের দিকে অনলাইন সংস্করণের সূচনা করে তবে যুক্তরাষ্ট্রে শতাধিক সংবাদপত্র অনলাইনে প্রকাশনা শুরু করে ১৯৯০ সালের শেষ দিকে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার শুরু ২০০৫ সালের দিকে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা না থাকায় ২০১০ সাল পর্যন্ত এ মাধ্যমের পাঠক ছিল হাতে গোনা এরপর দ্রুত গতিতে মানুষের দৌড় গোড়ায় পৌছে যায় ইন্টারেনেট সেবা আর তখনি বাড়তে থাকে অনলাইন পত্রিকার পাঠক দেশে বর্তমানে কয়েক ধরনের নিউজ পোর্টাল বা অনলাইন পত্রিকা রয়েছে : ১. ডেইলি ইভেন্ট নিউজ পোর্টাল ২. বিশেষ সংবাদভিত্তিক নিউজ পোর্টাল ৩. বিশেষায়িত নিউজ পোর্টাল ৪. মিশ্র নিউজ পোর্টাল

ডেনিয়েল সি. হালিন এবং পাওলো মানচিনি ২০০৪ সালে পশ্চিমের ১৮টি দেশের তুলনামূলক চিত্রের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম ব্যবস্থার তিনটি মডেলের কথা বলেছেন৷ সেগুলো হলো- ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোর সমবর্তিত বহুত্ববাদী মডেল, উত্তর/মধ্য ইউরোপের দেশগুলোর গণতান্ত্রিক কর্পেরেট মডেল এবং উত্তর আটলান্টিক দেশগুলোর উদারবাদী মডেল৷ আমাদের দেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে প্রথম মডেলের মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷ আটটি দেশের (স্পেন, ইটালি, ফ্রান্স, গ্রিস, পর্তুগাল, তুরস্ক, মাল্টা ও সাইপ্রাস) গণমাধ্যম ব্যবস্থা এই সমবর্তিত বহুত্ববাদী মডেলের অন্তর্ভুক্ত৷

বাংলাদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের যাত্রা খুব একটা বেশি দিনের নয় গণমাধ্যমের জন্য এই ধারাটি একটি সম্ভবানার দিক খুলে দিলেও অনেকে বর্তমানে এই ধারাটি নিয়ে প্রচুর বিরক্ত অনলাইন গণমাধ্যমগুলো নামে এখন প্রায়সই শোনা যায় নানান বদনাম

বিশ্লেষকরা মনে করেছেন, বর্তমানে অনলাইন গণমাধ্যমগুলো অপেশাদারিত্বের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে শ্লীল-অশ্লীল সংবাদ-ফিচার-ছবি নিয়েও আছে তর্কাতর্কি আর সাংবাদিকতার ‘এথিকস’ যেনো অনলাইন গণমাধ্যমগুলো তোয়াক্কাই করছে না

৯০ দশকের পর থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের এক অভাবনীয় পরিবর্তন সংঘটিত করেছে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬৭৮ টি সরকারি নথিভুক্ত পত্রিকা, ৭৫ টি'র ও বেশি রেডি ও টিভি চ্যানেল এবং অসংখ্য অনলাইন নিউজ পোর্টাল

একের পর এক ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে এই গণমাধ্যমগুলো সংখ্যার দিক থেকে গনমাধ্যমের পরিধি বাড়লেও এর মানের দিক দিয়ে পরিধি বাড়ছে কিনা তা নিয়ে রয়েছে বেশ সংশয়

বর্তামনে সস্তা ভিউ পাওয়ার আশায় অনলাইন গণমাধ্যমগুলো চটকদার শিরোনাম লিখছে যা দেখে পাঠক হচ্ছে বিভ্রান্ত ক্লিক করে ভেতরে পড়লে পাঠক শিরোনাম আর মূল খবরের সাথে কোনো মিল পাচ্ছে না এছাড়া সংবাদের সাথে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে অশ্লীল ছবি এমন অনেক সংবাদ দেখা যায় এসব গণমাধ্যমগুলোতে যেগুলো কিনা প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রিক মিডিয়ায় জায়গা করে নিতে পারেনি

অনলাইন গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে বিরাট অভিযোগ হচ্ছে গুজব রটানো সাঈদীকে চাঁদে দেখা গিয়েছে এই গুজব ছড়িয়ে পুরো দেশে এক অপ্রিতিকর ঘটনার জন্ম দিয়েছিলো এসব গণমাধ্যাম গুলো এছাড়াও ২০১২ সালে যখন সরকার নতুন করে আর কোন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তখন কক্সবাজারের কিছু স্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ভুয়া ছবি প্রকাশ করে যা স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে উত্তেজনা ও বিভ্রান্তি তৈরি করে

বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে তা হবে একটি দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ তারা আরো বলেন, এই দ্বায় অনলাইন গণমাধ্যমের মালিকগণ কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না কেননা, অধিক মুনাফার লোভে অনলাইন গণমাধ্যমের মালিকরা সাংবাদিকতার ছাত্র বাদেও এখানে অন্যান্য বিভাগের ছাত্রদের নিয়োগ দিয়ে থাকে যাদের স্বল্প বেতনে এখানে নিয়োগ দেওয়া যায় এছাড়া একটি বিষয়ে দক্ষ লোককে অন্যান্য বিষয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় একজনকে দিয়ে অধিক লোকের কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে

বর্তমানে অনলাইন গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে আরও বড় একটি অভিযোগ হচ্ছে, সময়মতো কর্মীদের বেতন না দেওয়া বেতনের বিষয়ে মালিকদের বললে ছাটাইয়ের শিকার হওয়া

সব বিষয় মিলিয়ে অনলাইন গণমাধ্যমগুলো পেশাদারিত্বের মাপকাঠি ছুঁতে পারছে না তবে হ্যাঁ, কিছু অনলাইন গণমাধ্যম পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করছে কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অপেশাদার নিউজ পোর্টালগুলোর বদনামের কাছে চাপা পড়ে যাচ্ছে পেশাদার নিউজ পোর্টালগুলো

লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ