ডেস্ক রিপোর্ট
মাংস খেতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ কমই আছেন। বিশেষত বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে মাংস একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ছুটি বা উৎসবের দিনগুলোতে একবেলা মাংসের কোনো পদ না হলে যেন হয়ই না।
বাংলাদেশ বা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ যেখানেই যান না কেনো বাঙালির হেঁশেলে খাসির মাংস জনপ্রিয় একটি নাম। আর খাসির মাংসের কথা এলে সবার প্রথমে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের নাম উঠে আসবে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল হতে পারে অন্যতম সম্ভাবনাময় একটি নাম। বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে এ ছাগলটি হতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস।
কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের যার কারণে একে ঘিরে এতো সম্ভাবনা- এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে প্রথমে বিশেষ প্রজাতির এ ছাগল সম্পর্কে একটু বলে নিই।
গ্রামাঞ্চলে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে অনেক সময় কালো ছাগল নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যায় এ ছাগলের বিস্তৃতি রয়েছে। মূলত এ প্রজাতির ছাগলের গায়ের রং কালো হওয়ায় এর নাম 'ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল'। তবে বাদামী, ধূসর এমনকি সাদা বর্ণের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলও রয়েছে। এ ছাগল আকারে তুলনামূলকভাবে ছোটো এবং পিঠের দিকটা সমতল। এ জাতের ছাগলের শিং ছোট ও পা খাটো। পূর্ণ বয়স্ক একটি ছাগলের ওজন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ কেজি হয়ে থাকে।
মাংস উৎপাদনের জন্য বিশ্বব্যাপী ভারতের যমুনাপাড়ি ছাগল, আফ্রিকার মাসাই ছাগল এবং চীনা জাতের ছাগল বেশ পরিচিত। আকারে তুলনামূলকভাবে এসব ছাগল বড় হওয়ায় এদের থেকে মাংস পাওয়া যায় বেশি। এমনকি দুধ উৎপাদন ক্ষমতাও বেশি থাকে। এরপরেও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বর্তমানে পৃথিবীতে ছাগলের সেরা জাত হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রথমত এ ছাগলের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু। এছাড়াও চামড়ার গুণগত মান বিবেচনায় এ প্রজাতির ছাগল সেরা। বিশ্ববাজারে ইতোমধ্যে এ প্রজাতির ছাগলের চামড়া 'কুষ্টিয়া গ্রেড' নামে পরিচিতি পেয়েছে।
অন্যান্য বেশিরভাগ প্রজাতির ছাগলের ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাচ্চা জন্মের পরই মারা যায়। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের ক্ষেত্রে এ হার মাত্র পাঁচ থেকে দশ শতাংশ। এ প্রজাতির মাদী ছাগল প্রতি বছর গড়ে দুইবার বাচ্চা দেয় এবং প্রতিবারে একসঙ্গে তিন থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। এ কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গলের জীবনচক্রে মোট বংশবৃদ্ধির হার অনেক বেশি।
ইউরোপের সাধারণ মানুষের খাদ্যতালিকায় মাংস একটি গুরত্বপূর্ণ উপাদান। তাদের বাজারে প্রাপ্ত মাংসের বড় অংশ আসে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড ও তুরস্ক থেকে। ইউরোপে মোট চাহিদার শতকরা আশি শতাংশ ছাগল ও ভেড়ার মাংসের যোগানদাতা হচ্ছে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নর্ভুক্ত দেশগুলোতে সব মিলিয়ে ৭০০ মিলিয়নের মতো ভেড়া ও ছাগল রয়েছে যাদের শতকরা পঁচাশি ভাগ বিভিন্ন খামারে প্রতিপালন করা হয়।
গরু কিংবা ভেড়ার মাংসে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি একটি প্রধান সমস্যা। তাই যাদের শরীরে উচ্চরক্তচাপ কিংবা কোলেস্টেরলজনিত সমস্যা রয়েছে তারা গরুর মাংস কিংবা ভেড়ার মাংস এড়িয়ে চলেন। এছাড়া ভেড়ার মাংসে এক ধরণের উৎকট গন্ধ থাকে যার কারণে অনেকে ভেড়ার মাংস খুব বেশি একটা পছন্দ করেন না। অন্যান্য রেড মিটের তুলনায় ছাগলের মাংসে ক্যালরি, সম্পৃক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরলের পরিমাণ অনেকটাই কম থাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকিই নেই বললেই চলে। পাশাপাশি সোডিয়ামের মাত্রা কম থাকায় এবং পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি হওয়ায় যারা একটু স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পছন্দ করেন তাদের কাছে ক্রমেই ছাগলের মাংস জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এক জরিপ অনুযায়ী, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাজারে প্রত্যেক বছর গড়ে ছাগলের মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে শতকরা দেড় শতাংশ। ক্রমবর্ধমান এ চাহিদার সামাল দিতে বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল হতে পারে অমিত সম্ভাবনার। অন্যান্য প্রজাতির ছাগলের মতো এ জাতের ছাগলের মাংসে তেমন কোনো কড়া গন্ধ নেই। চর্বির পরিমাণ কম থাকায় 'লিন' বানাতেও তেমন একটা অসুবিধা হয় না। স্বাদের দিক থেকেও এগিয়ে ব্ল্যাক বেঙ্গল প্রজাতির ছাগল। আর চামড়ার গুণগত মানের জন্য এদেশের চামড়াশিল্পেও বাড়তি মাত্রা যোগ করতে পারে এটি।
প্রত্যেক দেশের নিজস্ব কিছু ট্রেডমার্ক রয়েছে, একটি দেশের নামের সঙ্গে সঙ্গে কিছু পণ্যের নাম উচ্চারিত হয়। ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলকেও বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে নিজস্ব ট্রেডমার্ক হিসেবে তুলে ধরতে পারে। এজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করা জরুরি। তাহলে বিশ্বব্যাপী আলাদাভাবে এ প্রজাতির ছাগলের পরিচিতি তৈরি হবে। একই সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে এ ছাগলের মাংস ও চামড়া রপ্তানির জন্য যথার্থ উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে সরকার ও খামারিদের কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সোনালি আঁশ, হোয়াইট গোল্ডখ্যাত চিংড়ি এবং তৈরি পোশাকের মতো ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলও হয়ে উঠতে পারে এ দেশের ব্ল্যাক গোল্ড।