শিক্ষা ২৫ নভেম্বর, ২০২০ ১১:২২

উচ্চশিক্ষায় গবেষণা এবং ডা. দীপু মনির প্রত্যাশা

ড. মিল্টন বিশ্বাস       

২৪ নভেম্বর (২০২০) ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসে অবস্থিত বিইউপির একটি শিক্ষাবান্ধব সফটওয়্যারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন বেশি জোর দিতে হবে গবেষণার ক্ষেত্রে। তবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিয়ে নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মান হবে একটা প্রতিষ্ঠানের মান নির্ধারণের মাপকাঠি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে উচ্চশিক্ষা তথা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার সূতিকাগার।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষায় জিডিপির অন্তত চার শতাংশ বিনিয়োগের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমরা আজও তিন শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করতে পারছি না। তবে অন্যান্য যেসব বিষয়ে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, সেগুলো পক্ষান্তরে শিক্ষা খাতেই বিনিয়োগ হচ্ছে। কারণ সেগুলো শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করছে। দারিদ্র্য যেন কারও উচ্চ শিক্ষা অর্জনে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় আমাদের সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’ শিক্ষামন্ত্রীর প্রত্যাশা এবং বর্তমান বাস্তবতায় ইউজিসি’র বিভিন্ন উদ্যোগ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গবেষণার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে।

বর্তমান সরকারের সাড়ে ১১ বছরে দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ও দক্ষ উপাচার্য এবং কয়েকটিতে উপ-উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রশংসা অর্জন করেছেন। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের জীবন বৃত্তান্ত, একাডেমিক সাফল্য পর্যালোচনা করেই তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ প্রথমত উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যরা নিয়োগ পেয়েছেন একাডেমিক যোগ্যতায়। তারপর তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম ও সংস্কারমুক্ত মুক্তবুদ্ধির অনুসারী কিনা তা বিবেচনায় এনে প্রশাসনিক পদে পাঠানো হয়েছে। এসব চেতনায় অবিশ্বাসীরা কিংবা দুর্বল একাডেমিক রেকর্ড নিয়ে চাকরি প্রত্যাশীরাই মূলত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে থাকে, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ধরুন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট অনুসারে প্রশাসন পরিচালনায় উপাচার্যকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সেখানে সিনেট কিংবা অন্য কোনো পরিষদের (সিন্ডিকেট, ডিন) সদস্যদের জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা নেই। সেক্ষেত্রে উপাচার্য প্রফেসর ড. মীজানুর রহমান তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রাখবেন এটাই স্বাভাবিক। প্রশাসন চালাচ্ছেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুসারে, কারো প্রতি অনুরাগ কিংবা বিরাগের বশবর্তী হয়ে নন।

অনেক সময় দেখা গেছে সরকার দলীয় শিক্ষক কিংবা ছাত্র নেতাদের অযৌক্তিক দাবি মেনে নিতে অপারগ হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। উপাচার্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা বিরোধী দলের সমর্থক কেবল নয় নিজের দলের লাল-নীল শিক্ষকদের ইন্ধনেও হয়ে থাকে, যা ন্যক্কারজনক। নিজেদের স্বার্থ রক্ষা পেলে উপাচার্য ভালো বনে যান আর নিজেদের আনডিউ স্বার্থ হাসিল না হলে তিনি মন্দ হিসেবে গণ্য হন। এ বাস্তবতায় উপাচার্যদের দলীয় আনুগত্যকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রাজনীতিকে খারাপ বলার মধ্য দিয়ে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার চক্রান্ত করা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। কারণ অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম পাথেয় ছিল। তার ধারাবাহিকতায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনীতি চর্চা গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুসারে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরে নির্বাচিত উপাচার্য নিযুক্ত রয়েছেন। সেদিক থেকে দাবি করা যেতে পারে যে, উপাচার্য নিয়োগে গণতান্ত্রিক ধারা, যোগ্যতার মাপকাঠি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এর সবকিছু একীভূত। এ ধরনের ব্যবস্থা চর্চিত হলে উপাচার্যদের ছত্রছায়ায় দলীয় ছাত্র সংগঠনের বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ থাকবে না বলে আমাদের বিশ্বাস। তাছাড়া বর্তমান সরকার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বজায় রাখা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি’র জন্য কোনো ব্যাপার না। অবশ্য একথা ঠিক কোনো শিক্ষকের দলীয় মনোভাবে কাজ করা উচিত নয়। যা কিছু করা দরকার, সব শিক্ষা ও জাতীর স্বার্থে করতে হবে। কিন্তু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের জন্য সকল উপাচার্যকে ঢালাওভাবে দায়ী করাও ঠিক নয়। কারণ কোনো উপাচার্যের দলীয় মনোবৃত্তি নিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই। তবে যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কিছু সুযোগ-সুবিধা নিতে চায় এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দলীয়করণের সুযোগ কম। কারণ শিক্ষা নিয়ে দলীয়করণ করলে শিক্ষার মান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান ধরে রাখা সম্ভব নয়।

মানব জাতির কল্যাণকর, শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ সৃষ্টি শিক্ষার মূল লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা।’ তিনি আরো বলেছেন ‘শিক্ষা হলো, বাইরের প্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন।’ মানব শিশুর জন্মের পর থেকে ক্রমাগত এবং অব্যাহত পরিচর্যার মাধ্যমে তার দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে। অন্যদিকে নানা সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তার মানসিক বিকাশ হয়। উন্নত মানসিক বিকাশের ক্রমচর্চার মধ্যে দিয়ে নৈতিকতার পরিগঠনের মাধ্যমে আত্মার শুদ্ধি ঘটে। এজন্য বলা হয়ে থাকে দেহ, মন ও আত্মার সুসামঞ্জস্য বিকাশই শিক্ষা। এক কথায় পরিপূর্ণ মানব সত্তাকে লালন করে দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে, নিজেকে জাতির উপযোগী, যোগ্য, দক্ষ, সার্থক ও কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার নামই শিক্ষা।

শিক্ষা মানব জীবনের এক মূল্যবান সম্পদ। এ সম্পদ কখনই খোয়া যায় না বা বিলুপ্ত হয় না। বেঁচে থাকার জন্য, নিজেকে অভিযোজিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষা ব্যক্তির উন্নয়ন, সমাজের উন্নয়ন এবং দেশের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের প্রথম সরকার কর্মকা- শুরু করে। এখন ২০২০ সাল ‘মুজিববর্ষ’। এই দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, পাল্টে গেছে শিক্ষা-সংস্কৃতি, নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে মানুষের চিন্তাচেতনা। পাকিস্তান আমলে শিক্ষাপদ্ধতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি করেছিল। একাধিক শিক্ষা প্রণালি ছিল এর মূল কারণ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ‘কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন’-এর রিপোর্টে এ দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান নানারূপ বৈষম্য অবসানের কথা উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে পাকিস্তানের পুরনো ভূত ভর করে।

১৯৭৩ সালে চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তারও মৃত্যু ঘটে পঁচাত্তর-পরবর্তী স্বৈরশাসকদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে ব্যাপক উন্নয়নের জোয়ার চলছে। ঢাকায় ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ভালো সাফল্য দেখাচ্ছে। রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজাদপুর-শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোণার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর নতুন উৎসাহে একাডেমিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। যুগান্তকারী এসব উদ্যোগ চার দশকের শিক্ষাচিত্রে অনন্য সংযোজন। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইতোমধ্যেই বলেছেন, শ্রমশক্তিতে তারুণ্যের প্রাধান্য বাড়ায় আগামী ১০ বছর বাড়তি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এ সুবিধা পেতে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে নতুন কৌশল নিতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে কর্মমুখী উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষা। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পূর্ববর্তী সরকারের তৈরি নানান অসঙ্গতি দূর করা হচ্ছে।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগতমান নিশ্চিতকরণ ও তা বিশ্ব পর্যায়ে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর আলোকে ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল ফর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ ২০১২’ প্রবিধানমালা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তা বাস্তবায়িত করা হচ্ছে। দু’একটি বাদে এতোদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয় প্রচলন ছিল না। বর্তমান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি’র অনুরোধ রক্ষা করেছে অনেকেই; স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বিভাগে বাংলা ভাষা-সাহিত্য পড়ানো হয়। বাংলাদেশে বিদেশি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্থান ও পরিচালনা সংক্রান্ত প্রবিধানমালা প্রণয়নের কাজ চলছে।

বস্তুত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশিত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমান সরকারের সাড়ে ১১ বছরে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের অশান্ত পরিস্থিতিকে দ্রুত স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে সুস্থ মানসিকতা ও উচ্চ মানসম্পন্ন মনন সৃষ্টি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব। মুক্তচিন্তার চর্চা, নিরাসক্তভাবে সত্যের অনুসন্ধানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য- যার প্রধান অবলম্বন হলো গবেষণা। ডা. দীপু মনির শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহর ইউজিসি প্রশাসনের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম শ্রেণির বিদ্যাপীঠে পরিণত করতে সহায়ক হবে।

লেখক : কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, (email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)